E-Paper

ভোট-প্রচারে ফের আশ্বাস, ‘বাজি গড়’-এর দুয়ারে নেতারা

নুঙ্গি বাজি বাজারের জন্য এই এলাকার পরিচিতি রাজ্য জুড়ে। তল্লাটে বাজির রমরমা আগের মতোই আছে কি না, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তা দেখতেই মঙ্গলবার যাওয়াহয়েছিল।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩২
An image of closed shops

পর পর বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে বাজির দোকান। মঙ্গলবার, মহেশতলার চিংড়িপোতায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

বিস্ফোরণের পরে এই সিঁড়িতেই পড়েছিল মা আর মেয়ের দেহ। আর কিছুটা দূরে দরজার কাছে পড়েছিল বাচ্চা মেয়েটির শরীর। পরে তার একটা হাত পাওয়া গিয়েছিল সিঁড়ির নীচ থেকে! মাথার চুলগুলো এমন ভাবে পুড়েছিল যে, তাকানো যাচ্ছিল না।— গ্রামের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা পোড়া বাড়িটা দেখিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন বছর ৬০-এর ঝর্না হাতি। এর পরে বললেন, ‘‘দিদিমা, মা আর বোন যখন পুড়ছে, তখন ছোট ছেলেটা মাঠে খেলতে গিয়েছিল।’’ বলতে বলতে গলা বুজে আসে ঝর্নার।

মহেশতলা নন্দরামপুর দাসপাড়ার এই বাড়িটিই খবরের শিরোনামে এসেছিল গত মে-র শেষ দিকে। তদন্তে জানা যায়, চিংড়িপোতা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বাড়িটিতে বেআইনি ভাবে মজুত করে রাখা বাজি বিস্ফোরণে এই অঘটন। মৃত্যু হয়েছিল বাড়ির মালিক বছর ষাটের ঝুমা দাস, তাঁর মেয়ে পম্পা ঘাঁটি (৪২) এবং পম্পার মেয়ে জয়শ্রীর (৮)। তখন বাড়িতে না থাকায় বেঁচে গিয়েছিল পম্পার ছেলে, বছর তেরোর সুরজিৎ।

নুঙ্গি বাজি বাজারের জন্য এই এলাকার পরিচিতি রাজ্য জুড়ে। তল্লাটে বাজির রমরমা আগের মতোই আছে কি না, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তা দেখতেই মঙ্গলবার যাওয়া হয়েছিল। দেখা গেল, পোড়া বাড়ির দরজায় এখনও ঝুলছে পুলিশের লাগানো তালা। কালো হয়ে রয়েছে লোহার গ্রিল, দেওয়াল, মেঝে। ঘরের ভিতরে এখনও পড়ে কালো ছাই। এক কালে ছাদের ঘর বলে কিছু ছিল। এখন আর অবশিষ্ট নেই। সেই ঘরের উড়ে যাওয়া চাল দূরের গাছের ডালে ঝুলছে।

এলাকায় ঘুরলেই জানা যায়, প্রতি বছরই বাজি বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় এখানে। দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর ‘খবর’ বাইরে পৌঁছয় না। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও সমান ভাবে সামনে আসে। অভিযোগ, এমন ভাবে মামলা সাজানো হয়, যাতে জামিন পেয়ে ফের শুরু করা যায় বাজির ব্যবসা। বিস্ফোরণে প্রিয়জনের মৃত্যুর পরেও যা বন্ধ হয় না। ঘরে ঘরে রীতিমতো বারুদের স্তূপেচলতে থাকা বাজির কারবারে যোগ দেয় শিশুরাও। বাড়তে থাকে ফুসফুসের সমস্যা, ত্বকের নানা ধরনের রোগ।

তবে এ দিন গিয়ে দেখা গেল, পর পর বাজির দোকান তালাবন্ধ। দেওয়ালে ভোটের প্রচারের পাশেই ঝুলছে থানা থেকে লাগিয়ে দিয়ে যাওয়া বাজি তৈরি বন্ধ রাখার নির্দেশিকার পোস্টার। কয়েকটি দোকানের শাটারে ভোট প্রচারের আঁকা ছবি দেখিয়ে ঝর্নার স্বামী জীবনরাম হাতি বললেন, ‘‘মে মাসের ওই বিস্ফোরণের দিন থেকেই এই সব দোকান বন্ধ। কবে খুলবে কেউ জানে না। ফলে শাটার খুললে ভোটের প্রচার ঢাকা পড়ার ভাবনা নেই।’’

দোকান খোলার নিশ্চয়তা যে নেই, তা ধরা পড়ল ওই গ্রামেরই বাসিন্দা বাবলু দাসের কথায়। তিনিবললেন, ‘‘ওই বিস্ফোরণের রাতে এলাকায় পুলিশ নেমেছিল। রাতভর ধরপাকড় চলেছিল। তখন হাজারখানেক অস্থায়ী বাজির দোকান ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ৯৫ হাজার কিলোগ্রাম বাজি এবং বাজির মশলা বাজেয়াপ্ত হয়। ৩২ জনকে গ্রেফতার করা হলেও বাড়ির দরজা খুলিয়ে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল হাজারখানেক লোককে। ওই রকম সক্রিয় ভূমিকায় পুলিশকে কখনও দেখিনি।’’

একই রকম পরিস্থিতি হয়েছিল চম্পাহাটি, দক্ষিণ গড়িয়া, রামনগর, বেগমপুর, উত্তর রায়পুরের পঞ্চায়েত এলাকাগুলির অন্তর্গত ‘বাজিমহল্লা’ জুড়ে। এ দিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত চষে ফেলেও কোথাওই কোনও বাজির দোকান খোলা চোখে পড়ল না। সেখানকার এক টোটোচালক রতন কর্মকার বললেন, ‘‘বাজি উঠে গিয়েছে। এই সময়ে যে বাড়িতে বাজি তৈরির ব্যস্ততা থাকতচোখে পড়ার মতো, এখন সেখানে গৃহস্থ ঘুমোচ্ছেন।’’

তবে এর মধ্যেও বাজির স্বপ্ন ফেরি করছেন এলাকার বহু নেতা। মহেশতলা, বজবজ, বারুইপুরের ‘বাজি মহল্লা’র নেতা তথা ‘প্রদেশ আতশবাজি ব্যবসায়ী সমিতি’র সম্পাদক শুকদেব নস্কর বললেন, ‘‘বাজি ফিরবে, এই আশ্বাস নিয়েই তো ভোটের আগে প্রায় ১০ হাজার বাজি ব্যবসায়ীর পরিবারের কাছে যাচ্ছি। ভোট শেষে কথা না রাখলে হবে?’’

বাজির কারণে একের পর এক দুর্ঘটনায় বংশ পরম্পরার ব্যবসা থেকে মন উঠছে আগামী প্রজন্মেরও। মা, বোন, দিদিমাকে হারিয়ে এখন কাকার বাড়িতে বেড়ে ওঠা সুরজিতের কথাতেও সেই আভাস, ‘‘কাকু, মামাদের বলেছি, এই ব্যবসা ছেড়ে অন্য কোনও কাজ করো। বাজি আর ভাল লাগে না।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

West Bengal Panchayat Election 2023 Fire Crackers Fire Cracker Factory

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy