Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Manish Shukla

রাজনীতি না পুরনো দুশমনি? রহস্য বাড়ছে মণীশ খুনে

মণীশের সঙ্গে আরমানের পুরনো ‘দুশমনি’। এলাকায় শোনা যায়, আরমান ছাড়াও আরও বেশ কিছু দুষ্কৃতীর সঙ্গে ‘স্ট্রংম্যান’ মণীশের শত্রুতার কথা।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২০ ১৭:০২
Share: Save:

বিজেপি নেতা মণীশ শুক্ল খুনের পিছনে কারণ নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে। আর সেই রহস্যে ইন্ধন জুগিয়েছে এক রক্তদান শিবির। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে চর্চা এখন সেই শিবির ঘিরেই।

রবিবার দুপুরেই টিটাগড় পুরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে শাসক দলের পক্ষ থেকে একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে পুরসভার প্রশাসক প্রশান্ত চৌধুরী থেকে শুরু করে ছিলেন ব্যারাকপুর এলাকার তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নেতা লালন পাসওয়ান।

ভিড়ে ঠাসা বিটি রোডের উপর বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লকে এলোপাথাড়ি গুলি করে খুনের পর থেকেই বিজেপি নেতা এবং কর্মীদের অভিযোগের তির শাসক দলের দিকে। আর রবিবারের ওই রক্তদান শিবির এখন আলোচনার কেন্দ্রে। কারণ, এলাকার বিজেপি কর্মী সমর্থকদের দাবি, রবিবার দুপুরে ওই রক্তদান শিবিরেই আওয়াজ উঠেছিল, ‘‘ওদের মণীশ শুক্ল আছে। আমাদেরও পাল্টা আরমান মণ্ডল আছে।’’

আর সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করেই সোমবার দুপুরে টিটাগড় বাজারের এক বিজেপি সমর্থক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, ‘‘দুপুরেই হুমকি দেওয়া হল। আর রাতেই খুন!’’ কিন্তু এই আরমান মণ্ডল কে? এলাকার বাসিন্দারা আরমান মণ্ডলকে চেনেন থানার পাশেই টিটাগড় পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হিসাবে। পুরসভার এক প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলরের কথায়,‘‘আরমান এলাকার কুখ্যাত দুষ্কৃতী। প্রায় আড়াই বছর জেলে থাকার পর কয়েক মাস আগেই জামিনে মুক্ত হয়ে ফের পাড়ায় থাকা শুরু করেছে।”

এখানেই খুন হন মণীশ শুক্ল। —নিজস্ব চিত্র

আরও পড়ুন: রাজভবনে গেলেন না অফিসাররা, রাজ্যপালের জরুরি ডাক মুখ্যমন্ত্রীকে

এলাকার বিজেপি কর্মীদের দাবি, এলাকার তৃণমূল নেতারাই আরমানকে জামিনের জন্য সক্রিয় হয়েছিলেন। কারণ মণীশের সঙ্গে আরমানের পুরনো ‘দুশমনি’। আরমানের নামের সূত্রেই এলাকায় শোনা যায়, আরমান ছাড়াও আরও বেশ কিছু কুখ্যাত দুষ্কৃতীর সঙ্গে ‘স্ট্রংম্যান’ মণীশের শত্রুতার কথা। খড়দহের আদর্শপল্লির বাসিন্দা মণীশের রাজনৈতিক উত্থান যাঁরা দেখেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই স্বীকার করেন, সিপিএম-কংগ্রেস-তৃণমূল ঘুরে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মণীশ এলাকায় সবসময়েই পরিচিত ছিলেন ‘বাহুবলী’ রাজনীতিক হিসাবে। তাই মণীশের সঙ্গে ওই এলাকার অন্ধকার জগতের হোমরাচোমড়াদের সঙ্গে যে যোগাযোগ ছিল তা স্বীকার করেন অনেকেই। আর সেই যোগাযোগ বা ‘ওঠাবসা’-কেই খুনের পিছনে অন্যতম কারণ হিসাবে বর্ণনা করছেন রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের একাংশ। রাজ্য পুলিশের খাতায় মণীশ শুক্ল অন্তত ১৬টি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের টিটাগড়, জগদ্দল, বীজপুর, নৈহাটি এবং ব্যারাকপুর থানায় নথিভুক্ত এই মামলার তালিকায় খুন, ডাকাতি, অপহরণ, পুলিশকে মারধর থেকে শুরু করে অস্ত্র আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছে মণীশকে। আর তার শুরু বাম আমলের শেষ দিক অর্থাৎ ২০০৮-২০০৯ সাল থেকেই।

আরও পড়ুন: ‘ভণ্ডামি বেরিয়ে পড়েছে’, হাথরস-কাণ্ডে নীরবতা নিয়ে মোদীকে বিঁধলেন অধীর

মণীশের বিরুদ্ধে থাকা অপরাধের খতিয়ান উল্লেখ করে রাজ্য পুলিশের একাংশের ইঙ্গিত, ‘পুরনো শত্রুতা’ থাকতে পারে গোটা ঘটনার পিছনে। মণীশের হত্যা ‘রাজনৈতিক খুন’ নাও হতে পারে। তবে ঘটনার পিছনে রাজনীতি নেই সেই কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁর পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী এবং টিটাগড় পুরসভার বিদায়ী চেয়ারম্যান প্রশান্ত চৌধুরী। তিনি রবিবারের রক্তদান শিবির প্রসঙ্গে বলেন,‘‘রক্তদান শিবিরে গিয়েছিলাম। তবে মণীশ নিয়ে কোনও কিছু বলা হয়েছে কি না জানি না।’’ তিনি আরমানকে এলাকার কুখ্যাত দুষ্কৃতী হিসাবেই চিহ্নিত করেন। কিন্তু মণীশের খুন প্রসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘অর্জুন সিংহ বলছেন মণীশ তাঁর সঙ্গে ছিল। ফেরার পথে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তা হলে এটা তো বড় প্রশ্ন, মণীশ যে রবিবার রাতে টিটাগড়ে যাবে তা আততায়ীরা জানত। সেই খবর কে দিল?’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমার অফিস থেকে ঘটনাস্থল দেখা যায়। ওখানে ওরকম কিছু করতে গেল বড় ক্রিমিনাল হতে হবে।’’ তাঁর ইঙ্গিত মণীশের দল বা তাঁর কাছের লোকেদের দিকেই।

মণীশ শুক্ল খুনের প্রতিবাদ বিজেপির। —নিজস্ব চিত্র

প্রশ্নটা মণীশের সঙ্গীদেরও। কারণ কাকতালীয় ভাবে রবিবার মণীশের দেহরক্ষী দু’জনই ছুটিতে ছিলেন। ঘটনার পর বিজেপি কর্মী সমর্থকরা সিসি ক্যামেরার খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন, ঘটনাস্থলের পাশেই একটি ওষুধের দোকানে শনিবার পর্যন্ত যে সিসি ক্যামেরা ছিল, ঘটনার পর তা নেই। দোকানদারের দাবি, ক্যামেরা খারাপ হয়ে গিয়েছে বলে তিনি সারাতে দিয়েছেন। বিজেপি কর্মীদের দাবি, ‘‘ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত। এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মণীশের গতিবিধির ওপর নজর রেখেই খুনের ছক কষা হয়েছে।’’ তিনটে বাইকে আসা আততায়ীরা ব্যারাকপুরের দিক থেকে এসে খুব কাছ থেকে পর পর গুলি চালায় রাস্তার উপর দাঁড়ানো মণীশকে লক্ষ্য করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। কারণ পাশের একটি নার্সিংহোমে তাঁকে নিয়ে গেলে সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। সেখান থেকে বাইপাসের ধারে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সোমবার এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাঁর ময়নাতদন্ত হয়।

ব্যারাকপুর পুলিশের দাবি, তাঁরা তদন্ত শুরু করেছেন। কিছু উল্লেখযোগ্য সূত্রও পেয়েছেন। সিআইডির আধিকারিকরাও ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশকে তদন্তে সহায়তা করতে ঘটনাস্থলে গিয়েছেন এ দিন। রাজ্যপুলিশ এ দিন টুইট করে জানিয়েছে, পুলিশ হত্যার তদন্ত করছে এবং ব্যক্তিগত শত্রুতা-সহ খুনের সমস্ত সম্ভাব্য কারণ খতিয়ে দেখছে। তার আগে কোনও সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে অনুরোধ করা হয়েছে। রাজ্য পুলিশের টুইটে সোশ্যাল মিডিয়ায় দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করা থেকে দূরে থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। আশঙ্কার কারণ আছে পুলিশের। কারণ, মণীশের খুনের পর থেকেই এলাকায় গোষ্ঠী মেরুকরণ তীব্র হচ্ছে, যা যে কোনও সময় অশান্তি ঘটাতে পারে বলে ভয় পাচ্ছে পুলিশ।

তবে এ সব কিছুর মধ্যেও এই খুনের ঘটনায় রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন এলাকার শাসক দলের স্থানীয় অনেক নেতাই। টিটাগড়ের এক বিদায়ী কাউন্সিলরের কথায়, ‘‘অর্জুন মণীশকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিধানসভায় ব্যারাকপুর সিট জেতানোর।” দলের অন্দরে ব্যারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র দত্তের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অন্য এক কাউন্সিলরের কথায়,‘‘শীলভদ্রদাকে সরিয়ে এ বারে টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করছেন এলাকার একটি পুরসভার চেয়ারম্যান। টিকিট পেলে তাঁর সঙ্গে টক্কর হতো সরাসরি মণীশের সঙ্গেই। কারণ কয়েক দিন আগেই মণীশকে তৃণমূলে ফেরার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফিরতে রাজি হননি।’’ ওই তৃণমূল কাউন্সিলরের ইঙ্গিত, মণীশ তৃণমূলে থাকতেও দলের মধ্যে একটি বৃত্ত ছিল যারা মণীশের বিরুদ্ধে। পুরনো দলীয় সহকর্মীর খুনের পিছনে যে রাজনীতি রয়েছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই শাসক দলের ওই নেতার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Manish Shukla BJP Barrackpore Murder
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE