Advertisement
E-Paper

অভাবের সংসারে আক্রান্ত শৈশব, প্রশাসন কিন্তু চুপ

বারুদের আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা কী, তা খুব ভাল বোঝেন শিরিনা বিবি। আট মাস আগে পিংলার বাজি কারখানাতেই পুড়ে মারা গিয়েছিলেন তাঁর স্বামী শেখ রবিউল। তারপর মুর্শিদাবাদের সুতির নতুন চাঁদরা গ্রাম থেকে আর ছেলেদের পিংলার ব্রাহ্মণবাড় গ্রামে পাঠাতে চাইতেন না মা। খালি ভাবতেন, ‘ছেলেদেরও কী করে আগুনে দেব?’ বিশেষ করে ছোট ছেলে, বছর চোদ্দোর মুস্তাককে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।

বিমান হাজরা ও সুমন ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৫ ০৩:৪৭

বারুদের আগুনে পোড়ার যন্ত্রণা কী, তা খুব ভাল বোঝেন শিরিনা বিবি। আট মাস আগে পিংলার বাজি কারখানাতেই পুড়ে মারা গিয়েছিলেন তাঁর স্বামী শেখ রবিউল। তারপর মুর্শিদাবাদের সুতির নতুন চাঁদরা গ্রাম থেকে আর ছেলেদের পিংলার ব্রাহ্মণবাড় গ্রামে পাঠাতে চাইতেন না মা। খালি ভাবতেন, ‘ছেলেদেরও কী করে আগুনে দেব?’ বিশেষ করে ছোট ছেলে, বছর চোদ্দোর মুস্তাককে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ছেলেদের আটকাতে পারেননি শিরিনা। মাসে ছ’হাজার টাকা, বিনা পয়সায় থাকা-খাওয়ার সুযোগ তাঁদের মতো গরিব পরিবারে সহজে আসে না। এখন তাঁর দুই ছেলে, মুস্তাক আর জহিরুদ্দিন পোড়া দেহের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে বসে শিরিনা বললেন, ‘‘রাম মাইতি বারবার ছেলেদের ফোন করত। টাকার লোভ দেখাত। ওরা জোর করে চলে গেল।’’

একই কথা বললেন মৃত জওয়াসিম শেখের (১৪) বাবা আবু কালাম। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামের শেখ সুরজ সবাইকে নিয়ে আসত। এমন টাকার লোভ দেখাত, ছেলেদের আটকে রাখা যেত না।’’ সুরজও বিস্ফোরণে নিহত।

এ রাজ্যে বাজি তৈরির মতো বিপজ্জনক কাজ করতে যারা যায়, তাদের অধিকাংশই আট থেকে ১৫ বছরের শিশুশ্রমিক। ২০১৩-য় রাজ্যের আনাচে-কানাচে অবৈধ বাজি কারখানায় অগুন্তি শিশু শ্রমিকের নিয়োগ নিয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা করে দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাদের একটির তরফে নব দত্ত জানান, আদালত অন্তত তিন বার রাজ্যকে মতামত পেশ করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু দু’বছরেও সরকার কিছু জানায়নি। কেবল বাজিশিল্পই নয়, ইট ভাটা, পাথর ভাঙার কল প্রভৃতি নানা বিপজ্জনক কর্মস্থলে শিশুদের নিয়োগের প্রতিবাদে নানা সময়ে জনস্বার্থ মামলা করেছে নানা সংগঠন। কোনও ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকারের সাড়া মেলেনি।

রাজ্যের এই উদাসীনতার ফলে শিশুশ্রম প্রতিরোধের আইন রয়ে গিয়েছে খাতায় কলমে। এক দিকে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক, অন্য দিকে সস্তায় শ্রমিক-সন্ধানী মালিক, দু’য়ের মাঝে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে রাজ্যের গরিব শিশুরা। এ দিন মেদিনীপুরে বাবা-মায়েরা কেউ সন্তানের দেহ দেখে, কেউ বা তাদের ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা দেখে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। কঠোর বাস্তব কিন্তু এই যে, জীবন বাজি রেখে ছেলেদের কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন তাঁরাই।

‘বাজিগ্রাম’ বলেই পরিচিত সুতির নতুন চাঁদরা। নিমতিতা রেলগেট থেকে মাইল দেড়েক দূরে এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে এক সময়ে বাজি তৈরি হতো। বছর কয়েক আগে সুতির এক ওসির উপর বোমাবাজির ঘটনার পরে পুলিশ ওই গ্রামে তল্লাশি শুরু করে। তার পর থেকেই বাজি তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। তবে বারুদের সঙ্গে এই গ্রামের সম্পর্ক শেষ হয়নি। এখান থেকে বাজি তৈরির কারিগর হিসেবে মেদিনীপুর, বর্ধমান-সহ নানা এলাকায় যেত কিশোররা। দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা, থাকা-খাওয়া ‘ফ্রি’— এমন টোপে পা দিতেন মা-বাবারাও। দু’পক্ষই জানতেন কাজটা বাজির। তবে গ্রামের কেউ জিজ্ঞেস করলেই দু’তরফেই উত্তর মিলত, ‘‘রাজমিস্ত্রির কাজ।’’

গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা রবিউল ইসলাম অবশ্য কোনও রাখঢাক না করেই বলছেন, ‘‘এই গ্রামের ছেলে-বুড়ো সকলেই ভাল বাজি তৈরি করতে পারে। গ্রামে বাজি তৈরি বন্ধ হলেও মেদিনীপুরের ওই এলাকায় এই গ্রামের অনেকেই বাজি তৈরি করতে যান। এ বারেও সব জেনেশুনেই সেখানে গিয়েছিল।’’ কালনা, মেমারিতেই বাজি তৈরির কাজেও ওই গ্রামের কিশোররা যায় বলেও জানা গিয়েছে।

গ্রামবাসীদের একাংশ জানান, প্রায় ১২ দিন আগে মেদিনীপুর থেকে জনা চারেক লোক এসেছিল এই গ্রামে। তাদের সঙ্গে ছিলেন ‘মাইতিবাবু’ বলে এলাকায় পরিচিত এক ব্যক্তি। তাঁরা মুখে বলেছিলেন, রাজমিস্ত্রির কাজের জন্য তাঁদের কিছু ছেলে দরকার। তারপরেই এই এলাকা থেকে গত শনি ও সোমবার দু’দফায় ১৩ জন কিশোর কাজে গিয়েছিল পিংলায়। এদের মধ্যে ১০ জনেরই বয়স ১০-১৪ বছর। তাদের ফিরে আসার কথা ছিল জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ঈদের আগে।

বিস্ফোরণের খবর গ্রামে এসেছিল বুধবার গভীর রাতেই। ১১টি পরিবারের লোকজন রাতেই গাড়ি ভাড়া করে পিংলার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। নতুন চাঁদরায় বাড়ি আগলে রয়েছেন তাজমিরা বিবি। খবর পেয়েছেন, ছেলে নেই। বললেন, ‘‘সকলেই যাচ্ছে বলে ছেলেটাও গিয়েছিল। অভাবের সংসারে বাড়তি দু’পয়সা আয় হবে বলে আমরা বাধা দিইনি। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।’’ একই কথা শেখবানু বিবিরও। তাঁর কথায়, ‘‘বিড়ি বেঁধে আর ক’পয়সা পাই! তাই মেদিনীপুরের লোকেরা যখন এসে বলল রোজ ৫০০ টাকা করে মজুরি দেবে, তখন আর না করতে পারিনি।’’

জগতাই ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের শফিকুল শেখ বলেন, ‘‘ওই বাজি কারখানায় যারা কাজে গিয়েছিল তারা সকলেই খুব গরিব পরিবারের নাবালক কিশোর। দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি তো কম নয়। তাই লোভে পড়েই গিয়েছিল তারা। কিন্তু তার পরিণাম এমন হবে ভাবতে পারেনি।’’

সুতি ২ বিডিও দীপঙ্কর রায় অবশ্য বলেন, ‘‘অরঙ্গাবাদে কাজের অভাব নেই। বিড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এলাকার ৬ লক্ষ মানুষ। আসলে বেশি পয়সার হাতছানি পেয়েই গিয়েছিল ওই কিশোররা।’’

wretched childhood poverty stricken childhood suti children nimtita children pingla blast firecracker factories biman hazra suman ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy