Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শক্তিরূপেণ...

শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি বাঙালির আছে কি? শক্তিরূপিণীর আরাধনার মুখে এই চিরাচরিত প্রশ্নটা ফের উস্কে দিয়েছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে তাঁর অস্থায়ী নিয়োগ ঘিরে নৈতিকতার প্রশ্ন গড়িয়েছে আদালতে। আলাপনবাবু মেরুদণ্ড হারিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে রাজপথে নেমেছেন বিরোধীরা।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫৮
Share: Save:

শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি বাঙালির আছে কি? শক্তিরূপিণীর আরাধনার মুখে এই চিরাচরিত প্রশ্নটা ফের উস্কে দিয়েছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার পদে তাঁর অস্থায়ী নিয়োগ ঘিরে নৈতিকতার প্রশ্ন গড়িয়েছে আদালতে। আলাপনবাবু মেরুদণ্ড হারিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলে রাজপথে নেমেছেন বিরোধীরা।

নিয়োগকর্তার অন্যায় নির্দেশে না বলতে পারেননি আলাপনবাবু। অথচ একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখতে পেতেন, কেউ কেউ পেরেছেন। ঘটনাচক্রে তাঁরা সকলেই মহিলা। মীরা পাণ্ডে, নন্দিনী চক্রবর্তী, দময়ন্তী সেন, রীনা বেঙ্কটরামন, টুকটুক কুমার। গত কয়েক বছরে বাঙালি নারীশক্তির মুখ হিসেবে উঠে এসেছেন তাঁরা।

রাজ্য নির্বাচন কমিশন যে রাজ্যের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মতোই তার স্বতন্ত্র নিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মীরা পাণ্ডে। এ বারের বিধাননগরের ভোটের মতোই ২০১৩-র পঞ্চায়েত ভোটও খেয়ালখুশি মতো করতে চেয়েছিল তৃণমূল সরকার। কখনও ভোট এগিয়ে আনতে চেয়েছে, কখনও পিছিয়ে দিতে। কেন্দ্রীয় বাহিনী না-এনেই এক দফায় ভোট সেরে ফেলতে চেয়েছে রাজ্যের ১৯টি জেলায়। এটা আসলে ভোট লুঠ করার ছক, বিরোধীরা এমন অভিযোগ করলেও আমল দেয়নি শাসক দল। আমল দিয়েছেন তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরাদেবী। রাজ্যের অন্যায় আব্দার মানেননি তিনি। বাধা দিয়েছেন শাসক দলের যথেচ্ছাচারে, বিরোধীরা যাকে বলেছে ভোটের নামে প্রহসন। দ্বারস্থ হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের। শীর্ষ আদালতের রায়ে আদায় করেছেন কেন্দ্রীয় বাহিনী, ভোট করেছেন তিন দফায়।

তার পর পুরভোট নিয়েও সরকারি খামখেয়ালের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন মীরাদেবী। মূল্যও কম চোকাতে হয়নি। হুমকি চিঠি, কুৎসা, ফোনে গালিগালাজ, এমনকী ছেলের চাকরি নিয়েও অবান্তর প্রশ্ন তুলে তাঁকে আক্রমণ করেছে শাসক দল। মীরাদেবী দমেননি, পালিয়েও যাননি। মাথা উঁচু করে কাজ করেছেন শেষ দিন পর্যন্ত।

মীরাদেবীকে পদ থেকে সরানোর ক্ষমতা শাসক দলের ছিল না। কিন্তু পদের তোয়াক্কা করেননি আইপিএস দময়ন্তী সেন। ২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের পরেই তাকে ‘সাজানো ঘটনা’ তকমা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সেই অভিমুখে তদন্ত সাজাননি দময়ন্তী। জানিয়ে দিয়েছিলেন, ঘটনাটা ধর্ষণেরই। সে জন্য নজিরবিহীন ভাবে মহাকরণে তলব করে তাঁকে ধমক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে সরিয়েও দিয়েছেন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার(ক্রাইম) পদ থেকে। প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি দময়ন্তী। গোপনে বশ্যতাও স্বীকার করেননি। পুলিশ মহলের অনেকেরই মন্তব্য, যে আমলে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কালীপুজোয় উর্দি পরিহিত পুলিশকর্তার খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে তদারকি করা, শাসক দলের দুষ্কৃতীদের হাতে সহকর্মীকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকাই দস্তুর, সেখানে দময়ন্তী প্রতিবাদের উজ্জ্বল উদাহরণ।

একদা মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থেকেও হক কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন আর এক নারীশক্তি। আইএএস নন্দিনী চক্রবর্তী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে তাঁকে একই সঙ্গে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং তথ্য সংস্ক়ৃতি দফতরের সচিব পদে বহাল করেছিলেন। কিন্তু পদে পদে বিরোধ তৈরি হচ্ছিল। রাজ্য সচিবালয় সূত্র বলছে, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের অন্যায় চাপ উপেক্ষা করেই সিদ্ধান্ত নিতেন নন্দিনী। সেই বিরোধের আবহে পানাগড়ে মাটি উৎসবে না-যাওয়ায় আচমকা পদ খোয়ান তিনি। পাঠানো হয় ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারের স্টেট এডিটর পদে। তবুও দমানো যায়নি তাঁকে। পরে সুন্দরবন উন্নয়নের সচিব হয়েও ঠিকাদার চক্র ভাঙতে গিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে বিবাদে জড়ান নন্দিনী। আবার বদলি। এ বারও কম গুরুত্বের প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের কমিশনার পদে। আমলা মহলের অনেকেই নন্দিনীকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে বিবাদ মিটিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নন্দিনী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, মাথা উঁচু করে আইনের পথেই থাকতে চান তিনি।

আইনের পথে চলতে চেয়ে শাসক দলের রোষে পড়েছেন আরও দুই আমলা, রীনা বেঙ্কটরামন ও টুকুটুক কুমার। বাঁকুড়ার জেলাশাসক থাকাকালীন ঋজু স্বভাবের জন্য রীনাকে ডাকা হতো ‘বুলডোজার লেডি’ বলে। বার বার বদলি হলেও তাঁকে টলানো যায়নি। ‘‘অপমানিত হয়েছেন, কিন্তু রীনার মেরুদণ্ড সোজা থেকেছে বরাবর’’, মন্তব্য তাঁর এক সতীর্থের। তাই প্রোমোটারের হাতে উদ্বাস্তু কলোনির জমি তুলে দেওয়ার জন্য মন্ত্রীমশাই চাপ দিলেও মেনে নেননি রীনা। একই ভাবে আইসিডিএস প্রকল্পের চাল-ডাল মন্ত্রীর ইচ্ছায় বিনা টেন্ডারে কিনতে রাজি হননি টুকটুক কুমার। বিরোধ হয়েছে, কিন্তু দমেননি। নীতিনিষ্ঠ থেকে রাজ্য ছেড়েই চলে গিয়েছেন তিনি। নবান্নের আধিকারিক মহল বলছে, রাজ্যের ভাঁড়ে মা ভবানী কোষাগার থেকে মেলা-খেলা-উৎসবের জন্য দেদার বাজে খরচ দেখেও মন্ত্রীরা যখন ‘ইয়েস ম্যাডাম’ বলে সুরে সুর মেলান, তখন নয়ছয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোটা বড় ব্যাপার বৈকি।

প্রশ্ন হল, মহিলারা যখন শিরদাঁড়া সোজা করে রাখতে পারেন, তখন পুরুষরা পিছিয়ে কেন? বাঙালি পুরুষের পোষ মানা স্বভাবের কথা রবি ঠাকুর বলে গিয়েছিলেন। এত কাল পরেও তার স্বভাব পাল্টায়নি। অন্য দিকে বাংলার সমাজজীবনে মাথা তুলেছেন মেয়েরা। অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, আপস না-করা প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবেই রাজনীতির ময়দানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান। ইদানীং যেমন বিজেপিতে নজর কাড়ছেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। পুরুষেরা যেখানে ম্রিয়মান, সেখানে পাড়ুইয়ের ধর্ষিতার পাশে দাঁড়ানো হোক বা অশোকনগরের ত্রাণশিবির— রূপার প্রতিবাদী উপস্থিতি অনেকেরই নজর কাড়ছে।

সেন্টার ফর সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক প্রদীপ বসুর মতে, দীর্ঘদিন আমলাতন্ত্র জিনিসটা ছিল পুরুষশাসিত। তাঁর কথায়, ‘‘নিয়ম ছিল, আমলারা কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে মন্ত্রীকে সাহায্য করবেন। কিন্তু সেই র‌্যাশনাল সিস্টেমটাই বাংলায় স্তিমিত, সন্ত্রস্ত।’’ আর পুরুষের সেই মেরুদণ্ডহীনতার ফাঁক পূরণ করতে এগিয়ে আসছেন নারীরা।

‘‘মেয়েরা নানা ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, পুরুষ এখন আর তাই প্রতিবাদের প্রয়োজন বোধ করে না,’’ বললেন ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র লেখক গোলাম মুর্শেদ। কিন্তু এই কাপুরুষোচিত নীরবতাই কি বাঙালি পুরুষের ভবিতব্য? কিঞ্চিৎ ঘুরে দাঁড়ানোর উদাহরণ যে একেবারে নেই তা নয়। শাসক দলের চার নেতা-মন্ত্রীর চাপের কাছে নতিস্বীকার করার পরেও রাতারাতি পদ ছেড়ে অন্তত নিজের বিবেকের কাছে দায়মুক্ত হয়েছেন সদ্য প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়।

সমাজের কাছে কবে দায়বদ্ধ হবে বাঙালি পুরুষ?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE