Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
বিতর্কে পুলিশ

শিক্ষকদের ধরার ভুল শুধরে দুষ্কৃতীকে ছাড়ার নতুন ভুল

মিসটেক, মিসটেক! একটা ‘মিসটেক’ ঢাকতে গিয়ে আর একটা ‘মিসটেক’ করে বসল ব্যারাকপুরের পুলিশ! গত শুক্রবার আড়িয়াদহের একটি বাড়ি থেকে ডাকাত সন্দেহে হিঙ্গলগঞ্জের সাত শিক্ষক এবং এক দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছিল বেলঘরিয়া থানার পুলিশ।

মধ্যমগ্রামে জেলা তৃণমূল অফিসে হিঙ্গলগঞ্জের সাত শিক্ষক।

মধ্যমগ্রামে জেলা তৃণমূল অফিসে হিঙ্গলগঞ্জের সাত শিক্ষক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

মিসটেক, মিসটেক! একটা ‘মিসটেক’ ঢাকতে গিয়ে আর একটা ‘মিসটেক’ করে বসল ব্যারাকপুরের পুলিশ!

গত শুক্রবার আড়িয়াদহের একটি বাড়ি থেকে ডাকাত সন্দেহে হিঙ্গলগঞ্জের সাত শিক্ষক এবং এক দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছিল বেলঘরিয়া থানার পুলিশ। তদন্তকারীরা আদালতে দাবি করেছিলেন, আট জনই ডাকাতির উদ্দেশ্যে আড়িয়াদহে জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু ধৃত শিক্ষকদের পরিবারের তরফে প্রথম থেকেই বলা হয় যে, বড় ভুল হচ্ছে। সাত শিক্ষক চাকরি সংক্রান্ত একটি পরীক্ষা দিতে হিঙ্গলগঞ্জ থেকে এসে একটি ঘরভাড়া করে ছিলেন। এলাকায় নতুন মুখ দেখে পুলিশ ভুল সন্দেহে তাঁদের গ্রেফতার করেছে।

সোমবার ভুল স্বীকার করে নিল পুলিশও। পুলিশ কর্তারা জানিয়ে দিলেন— হিঙ্গলগঞ্জের সাত ব্যক্তি ডাকাত নন, শিক্ষক। সেই মতো আদালতের কাছে ‘মিসটেক অব ফ্যাক্ট’ রিপোর্টও পেশ করল পুলিশ। কিন্তু ভুল স্বীকারের রিপোর্টেই ফের ভুল করে ধৃত ‘আট জনই নির্দোষ’ বলে উল্লেখ করায় আদালত এ দিন ধৃতদের আট জনকেই মুক্তি দিয়েছে। ফলে শিক্ষকদের সঙ্গে মুক্তি পেয়ে গিয়েছে দাগি দুষ্কৃতীও। উপর্যুপরি ভুলের দায়ে এ দিন রাতে বেলঘরিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মী সুকান্ত দাস এবং গোবিন্দগোপাল গোস্বামীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে এবং ওই থানার এক তদন্তকারী অফিসার মেঘমা গুহ সাউয়ের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কী ভাবে ঘটে গেল গোটা ঘটনাটা?

শুক্রবার বেলঘরিয়া থানার পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পায় বরাহনগর বা কামারহাটি এলাকায় বড়সড় অপরাধ ঘটানোর জন্য কয়েক জন অপরিচিত লোক আড়িয়াদহের পাঠবাড়ি লেনের নিউ মল্লিক কলোনিতে ঘোরাফেরা করছে। রাতে সাদা পোশাকের বিশাল পুলিশ বাহিনী ওই এলাকায় যায়। পুলিশ সূত্রের খবর, সেখানে গিয়ে জানা যায়, একটি বাড়িতে কয়েক জন লোক একদিন আগে ভাড়া এসেছেন। এলাকায় তল্লাশি চালাতে গিয়ে চাঁদু ও তার শাগরেদদের দেখা পায় পুলিশ। তখন তাড়া করে চাঁদুকে ধরে ফেললেও তার এক সঙ্গী ওই সাত শিক্ষক যে বাড়িতে ভাড়া ছিলেন, সেই গলিতে ঢুকে পড়ে। পুলিশ ওই বাড়ির গলিতে ঢুকে একটা ব্যাগ উদ্ধার করে। তার মধ্যে ছিল কয়েকটি ধারালো অস্ত্র। এর পরে ওই বাড়িতে তল্লাশি চালানোর সময় একটা ঘর থেকে একসঙ্গে অপরিচিত সাত জনকে দেখতে পেয়ে তাদেরও চাঁদুর শাগরেদ মনে করে তড়িঘড়ি গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। পরের দিন অর্থাৎ ৮ অগস্ট সকালে ৮ দুষ্কৃতী অস্ত্র-সহ ডাকাতির উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছিল বলে মামলা দায়ের করে আদালতে পাঠিয়ে দেয়।

কিন্তু পরে ওই শিক্ষকেরা যে ঘরে ভাড়া এসেছিলেন, সেখানে তল্লাশি করে সাত জনের অ্যাডমিট কার্ড, ভোটার কার্ড উদ্ধার হয়। তখন প্রমাণ হয়ে যায়, ওই সাত জন পরীক্ষা দিতেই কলকাতায় এসেছিলেন। পুলিশ নিজের ভুল বুঝতে পারে। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ এ দিন রাতে বলেন, ‘‘শনাক্তকরণের কাজে কিছু খামতি হয়েছে। আমরা অপরাধের খবর পেয়েই ওখানে গিয়েছিলাম। ছোটাছুটির সময়ে একটা ভুল হয়ে যায়।’’ এ দিন আদালতেও এর জন্য একপ্রস্ত তিরস্কৃত হতে হয়েছে পুলিশকে।

এ দিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ ভারপ্রাপ্ত এসিজেএম পরাগ নিয়োগীর এজলাসে মামলাটি ওঠে। বিচারক ডেকে পাঠান তদন্তকারী অফিসারকে। তদন্তকারী অফিসার জানান, অভিযোগকারী অফিসারের কথার ভিত্তিতেই তিনি এই মামলার তদন্ত করেছেন এবং রিপোর্ট দিয়েছেন। সিজার লিস্টে দেখানো ছুরি, লাঠিগুলো থানার মালখানাতে ছিল। অভিযোগকারী প্রবেশনারি এসআই সুকান্ত দাস সেগুলি তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এর পরে বিচারক ডেকে পাঠান সুকান্তবাবুকে। তিনি তখন বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ডিউটি করছিলেন। ৪টে নাগাদ তিনি আদালতে বিচারকের সামনে হাজির হন। এই ঘটনা কী করে ঘটল, বিচারক তাঁর কাছে জানতে চান। চুপ করে থাকেন সুকান্তবাবু।

ধৃতদের আইনজীবীরা বলেন, ‘‘পুলিশ স্বীকার করেছে, ধৃতরা সবাই নির্দোষ। তাই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হোক।’’ সরকারি আইনজীবী পুলিশের রিপোর্টের সপক্ষে বলেন, ‘‘পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে ধৃতরা সবাই নির্দোষ।’’ এর পরেই ধৃত আট জনকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারক। কিন্তু সাত জনের বদলে আট জনকে কেন নির্দোষ বলা হল, তা নিয়ে পুলিশ মহলেই প্রশ্ন উঠেছে। ব্যারাকপুরের এক পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘এ তো মিসটেকের উপর মিসটেক! শিক্ষকদের ধরার ভুল ঢাকতে গিয়ে একটা দাগি আসামিকেও ছাড়তে হল!’’


পুলিশের ‘মিসটেক অব ফ্যাক্ট’ রিপোর্ট।

মুক্তির নির্দেশ আসার পরে শুরু হয় আর এক প্রস্ত নাটক। বিকেল পাঁচটা নাগাদ ব্যারাকপুর উপ-সংশোধনাগার থেকে বের হন সাত জন শিক্ষক। কার্যত তাঁদের ‘হাইজ্যাক’ করে একটি টাটা সুমো গাড়িতে তুলে দেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় মধ্যমগ্রামের জেলা তৃণমূল অফিসে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলা সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ও জেলার পর্যবেক্ষক নির্মল ঘোষ। তাঁদের সামনে বসেই এক শিক্ষক বলেন, ‘‘গ্রেফতার করার সময়ে পুলিশ আমাদের সাত জনের কোনও কথাই শুনতে চায়নি। পরিচয়পত্রও দেখতে চায়নি। থানায় নিয়ে গিয়ে লকআপে ঢুকিয়ে দেয়।’’ এই কথা বলার পরে তাঁদের গাড়িতে চাপিয়ে হিঙ্গলগঞ্জে পাঠানোর নির্দেশ দেন জ্যোতিপ্রিয়বাবু।

তবে এ ভাবে শিক্ষকদের পার্টি অফিসে নিয়ে যাওয়া হল কেন, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মানবাধিকার ও শিক্ষক সংগঠনের একাংশ। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর সহ-সভাপতি আলতাফ আহমেদ বলেন, ‘‘আদালত থেকে তৃণমূল পার্টি অফিসে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা আর কিছুই হতে পারে না।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘শিক্ষকরা যাতে জেল থেকে বেরিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে না পারেন, সেই ভয়েই ক্ষমতার বেড়াজালে তাঁদের আটকে দেওয়া হল।’’ বামপন্থী প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের জেলা সম্পাদক দীপক ঘোষ বলেন, ‘‘ওঁরা শিক্ষক। তাঁদের এক বার জেল, এক বার দলীয় অফিস— এ ভাবে টানাহ্যাঁচড়া করা উচিত নয়।’’

এর উত্তরে জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘শিক্ষকদের যাতে কোনও সমস্যা না হয় এবং তাঁরা ঠিক ভাবে বাড়ি ফিরতে পারেন, সে জন্যই তাঁদের তৃণমূল অফিসে ডাকা হয়েছিল।’’ পাশাপাশি খাদ্যমন্ত্রীর দাবি, পুলিশ কোনও ভুল করেনি। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশ নিজের কাজ করেছে। তাদের কোনও ভুল নেই। প্রত্যেকেরই উচিত নিজের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা।’’

—নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE