অাতিকুল রহমান। —নিজস্ব চিত্র।
সামান্য বচসা। সেখান থেকে কথা কাটাকাটি। আর তার পরেই গুলি।
সাতসকালে কলকাতা শহরে প্রকাশ্য রাস্তার উপরে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে করা সেই গুলিতেই খুন হয়ে গেলেন বছর চল্লিশের এক ব্যক্তি। যাঁর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ, এর পর সেই প্রোমোটারের বাড়িতে চড়াও হয় জনতা। সেখানে চলে ভাঙচুর। মঙ্গলবার সকালে পুলিশের সামনেই কার্যত নৈরাজ্যের চেহারা নেয় কড়েয়া থানার ব্রাইট স্ট্রিট এলাকা।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, খুন হওয়া ব্যক্তির নাম আতিকুল ওরফে ফজরুল রহমান (৪০)। তাঁর বাড়ি কড়েয়া থানার ব্রাইট স্ট্রিটে। পেশায় প্রোমোটার ছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ঝামেলার জেরেই আতিকুলকে গুলি করে ভোলা ওরফে শেখ ইদ্রিশ নামে তাঁরই এক প্রতিবেশী। তিনিও পেশায় প্রোমোটার। ঘটনার পর এলাকা থেকে চম্পট দেন অভিযুক্ত ভোলা। এ দিন সন্ধ্যায় তাঁকে ব্রাউট স্ট্রিট এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ দিন সকাল ৮টা নাগাদ ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিতে যাওয়ার জন্য বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন আতিকুল। সেই সময়ে সেখানে ভোলা আসেন। আতিকুলের সঙ্গে তাঁর বচসা শুরু হয়। দু’জনের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে সেখানে পৌঁছন আতিকুরের বোন এবং ভগ্নিপতি। দু’জনের মধ্যে কথাকাটাকাটি থামানোর চেষ্টাও করেন তাঁরা। আতিকুলের বোন জানিয়েছেন, কিছুতেই ঝগড়া থামানো যায়নি। কথা কাটাকাটির মধ্যে হঠাৎই কোমরে গোঁজা একটি আগ্নেয়াস্ত্র বার করে আতিকুলের পেটের বাঁ-দিকে গুলি চালায় ভোলা। রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েন তাঁর দাদা। ঘটনার পরই সেখান থেকে চম্পট দেন ভোলা। গুরুতর জখম আতিকুলকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
প্রোমোটারকে খুনের প্রতিবাদে আছড়ে পড়ল জনরোষ।ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
সম্প্রতি ভোলা বাগদাদ থেকে ঘুরে এসেছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। সে এবং আতিকুল দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং পড়শি। যে চিলতে জায়গার দখল নিয়ে দু’জনের সংঘাত, তা-ও ঘটনাস্থলের কাছেই। সেখানে একটি বহুতলে মুখোমুখি দু’টি ফ্ল্যাটের মালিক আতিকুল এবং ভোলা। দু’টি ফ্ল্যাটের মাঝে মেরেকেটে ৩০ স্কোয়ার ফুট একটি জায়গা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই ছোট জায়গার বাজারদর বর্গফুটে ৩৫০০-৪০০০ টাকা। অর্থাৎ, সাড়ে ১০ থেকে ১২ লক্ষ টাকা! এই জমির দখল নিয়েই ঝগড়া।
পুলিশের একাংশ জানিয়েছে, ভোলার সঙ্গে প্রোমোটিং করতেন আতিকুল। পুরনো কিছু কাজ চললেও ইদানীং ভোলার সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দেন তিনি। পুলিশের অনুমান, প্রোমোটিংয়ের জায়গা দখল বা বখরার ভাগ নিয়ে গোলমালেই তাঁদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। প্রোমোটিংয়ের কারবারে দু’জনের চেনা লোকেদের জেরা করছেন গোয়েন্দারা।
তবে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, যে বহুতল নিয়ে গোলমাল, তাতে ভোলা অংশীদার হিসেবে যুক্ত ছিল না। কিন্তু ভোলার সঙ্গে আতিকুলের একটা বোঝাপড়া ছিল। যার জেরে আতিকুলের কাছ থেকে নির্মাণ বাবদ টাকা নিত ভোলা।
আরও পড়ুন
ফুটপাথে বেপরোয়া বাস, মাসুল গুনলেন পথচারী
ঘটনার পর ভোলার (ইনসেটে) অফিসে ভাঙচুর করে উত্তেজিত জনতা। —নিজস্ব চিত্র।
আতিকুলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই ভোলার বাড়িতে চড়াও হয় উত্তেজিত জনতা। ভোলার বাড়িতে ঢুকে শুরু হয় ভাঙচুর। গাঁইতি, শাবল দিয়ে তাঁর অফিস ভাঙচুর করা হয়। কাগজ-আসবাবপত্র রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হয়। তাতে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয়দের দাবি, এলাকায় একাধিক অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভোলা। এ জন্য জেলও হয়েছিল তাঁর। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এলাকাতেই প্রোমোটিং ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ব্রাইট স্ট্রিটে একটি নির্মাণকাজ নিয়েই সম্প্রতি আতিকুলের সঙ্গে তাঁর ঝামেলার সূত্রপাত। মাস ছয়েক আগে তা নিয়ে দু’জনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতিও হয় বলে দাবি এলাকাবাসীর।
আরও পড়ুন
বিমানসেবিকার কাছে মিলল প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা!
ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন আতিকুলের মা। —নিজস্ব চিত্র।
ঘটনার পরই বিশাল বাহিনী নিয়ে এলাকায় পৌঁছয় কড়েয়া থানার পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, আতিকুলের পাড়াতেই থাকেন ভোলা। সেখানে তাঁর অফিসও রয়েছে। এ দিন ব্রাইট স্ট্রিটে পৌঁছে ভোলার বাড়ি তথা অফিস সিল করে দেয় পুলিশ। কড়েয়া থানার পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পর থেকেই এলাকা থেকে পালিয়ে যান ভোলা। পরে অবশ্য পুলিশের জালে ধরা পড়েন তিনি। আতিকুলকে কেন খুন করা হল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আতিকুল ওরফে ফজলুর রহমান (নিহত প্রোমোটার)
কড়েয়ায় একাধিক বহুতল নির্মাণে যুক্ত।
ব্রাইট স্ট্রিটে মা, ভাই, স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকে নিয়ে বসবাস।
তিন বোনের বিয়ে দিয়েছেন। মেজ ভাই কয়েক বছর আগে জলে ডুবে মারা যান।
শেখ ইদ্রিস ওরফে লম্বু ভোলা জেলে গেলে অপরাধ জগৎ থেকে সরে প্রোমোটার হিসেবে নাম লেখানো।
২০১৪-য় জেলফেরত বন্ধু ভোলাকে নিয়ে প্রোমোটারি।
পরে গন্ডগোল হলে ভোলার সঙ্গ ছেড়ে দেওয়া।
২০০১-এর আগে তোলাবাজির কিছু পুরনো অভিযোগে পুলিশের খাতায় নাম ছিল।
উপকারী, সদাশয় বলে পরিচিত পাড়ায়।
ভোলার গুলিতে লুটিয়ে পড়েন, এসএসকেএমে মৃত বলে ঘোষণা।
শেখ ইদ্রিস ওরফে লম্বু ভোলা (অভিযুক্ত প্রোমোটার)
খুন, তোলাবাজি ও খুনের চেষ্টায় বারবার অভিযুক্ত।
ক্ষুর চালানো, গুলি ছোড়ায় ওস্তাদ।
ব্রাইট স্ট্রিটে শ্বশুরবাড়ি। স্ত্রী ও দুই ছেলে আছেন।
মা কাশ্মীরে থাকেন, বোনের কাছে। অন্য ভাই মল্লিকপুর রিকশা চালান।
২০০১-‘০২ সালের দু’টি খুনের ঘটনার একটিতে দোষী সাব্যস্ত।
২০১৪ সালে ছাড়া পায়। কিন্তু তার পরেও গুন্ডা দমন শাখার হাতে গ্রেফতার। জামিনে মুক্ত।
ফিরে এসে ছোটবেলার বন্ধু আতিকুলের সঙ্গে কড়েয়া এলাকায় প্রোমোটার হিসেবে কাজ শুরু।
বেআইনি নির্মাণ এবং তোলাবাজির অভিযোগ।
আতিকুলকে গুলি করে পলাতক বলে অভিযোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy