Advertisement
E-Paper

তুই পিছনে আয়, বলেছিলেন পিন্টু

সাইকেল ভ্যানের উপরে কাপড়ে ঢাকা দেহটার পাশে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলেন এক যুবক। নিজের মনেই বলে যাচ্ছিলেন, এক সঙ্গে কেন যে এলাম না! তাহলে হয়তো ওকে অকালে চলে যেত হত না।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৬ ০১:৫৩
জনরোষ সামলাতে পিস্তল উঁচিয়ে পুলিশ। (মাঝে), মোটরবাইক আরোহী পিন্টুকে চাপা দিয়ে সেতুর রেলিং ভেঙে নীচে পড়ে যাওয়া ট্রাক।

জনরোষ সামলাতে পিস্তল উঁচিয়ে পুলিশ। (মাঝে), মোটরবাইক আরোহী পিন্টুকে চাপা দিয়ে সেতুর রেলিং ভেঙে নীচে পড়ে যাওয়া ট্রাক।

সাইকেল ভ্যানের উপরে কাপড়ে ঢাকা দেহটার পাশে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলেন এক যুবক। নিজের মনেই বলে যাচ্ছিলেন, এক সঙ্গে কেন যে এলাম না! তাহলে হয়তো ওকে অকালে চলে যেত হত না।

বিষ্ণুপুর শহরে যে বন্ধুকে ঘণ্টাখানেক আগেও হন্তদন্ত হয়ে বাজার করতে দেখেছিলেন বিশ্বজিৎ সরকার, সেই পিন্টু বারিকেরই (২৬) দেহ যে তাঁর সামনে পড়ে রয়েছে কিছুতে যেন বিশ্বাস করতে পাচ্ছিলেন না তিনি। বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ বিষ্ণুপুরের চকবাজারে কেনাকাটা করছিল পিন্টু। বলেছিলাম, ‘একটু দাঁড়া। ব্যাঙ্কের কাজ সেরে আসি। এক সঙ্গেই বাড়ি ফিরব।’ কিন্তু ওর ফেরার তাড়া ছিল। তাই বলল- ‘আমি এগোচ্ছি। তুই পিছনে আয়।’ কিন্তু সেটাই কাল হল!’’

গ্রামে ফিরে বিশ্বজিৎ শোনেন তাঁর প্রিয় বন্ধু আর নেই। সাইকেল ভ্যানের উপরে ঢাকা তাঁর দেহ। কিছুতেই তাঁকে থামানো যাচ্ছিল না। বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘এই তো ২৮ দিন আগে ওর বিয়ে দিতে গিয়েছিলাম পশ্চিম মেদিনীপুরের হুমগড়ে। কত হই-হুল্লোড় করলাম। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে ভাবতেই পারছি না।’’

বিশ্বাস করতে পারছেন না বিষ্ণুপুরের খড়িকাশুলি লাগোয়া তিন নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দারাও। একমাসের মধ্যে কারও জীবনের রং যে এতটা ফিকে হয়ে যেতে পারে ভাবতে পারছেন না তাঁরাও। ছেলেবেলা থেকে ছেলেটা মামার বাড়িতে মানুষ হচ্ছিল। লড়াই করে ব্যবসা করে জীবনে স্বাবলম্বী হয়েছিলেন। সংসারে একটু স্বচ্ছলতা আসতে বিয়ে করেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাঁর জীবনে যে অন্ধকার নেমে আসতে চলেছে কে বা তা আঁচ করেছিলেন! মঙ্গলবার দুপুরে বেলশুলিয়ার সেতুতে ট্রাকের ধাক্কায় পিন্টুর মৃত্যুর খবর তাই তাঁর পরিবারের কাছে যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনই অবাক তাঁর পড়শিরাও।

শোকে ভেঙে পড়েছেন পিন্টুর স্ত্রী। ছবি: শুভ্র মিত্র

বিষ্ণুপুরে-মেদিনীপুর ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে এ দিন দুপুরে একটি ট্রাক বেলশুলিয়ায় সেচখাল পার হওয়ার সময় সেতুতে মোটরবাইক চালক পিন্টুকে ধাক্কা মেরে তাঁকে নিয়ে নীচে আছড়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। পরে মারা যান বীরভূমের দুবরাজপুর এলাকার ট্রাকচালক জয়প্রকাশ পান্ডে (৪০)। আহত হয়েছেন বর্ধমানের কর্জনাচটির বাসিন্দা খালাসি রাজেশ কর্মকার। রাস্তায় টহলদার পুলিশের তোলাবাজি থেকে রেহাই পেতেই ট্রাকচালক দ্রুতগতিতে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন বলে বাসিন্দারা অভিযোগ তোলেন।

দুপুরে যখন ঘটনাস্থলে ওই অভিযোগকে ঘিরে উন্মত্ত জনতার সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ চলছে, সেই সময় কান্নার রোল পড়েছে কয়েক কিলোমিটার দূরে তিন নম্বর ক্যাম্পে পিন্টুর মামারবাড়িতে। বাড়ির ভিতরে কেঁদে যাচ্ছিলেন পিন্টুর স্ত্রী দীপাদেবী। ভেঙে পড়েছেন পিন্টুর মামা অনিল ঘুঘু, মামিমা চম্পাদেবী। কেউই কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তাঁদের স্বান্তনা দিচ্ছিলেন পড়শিরা। তাঁদেরই কয়েকজন জানান, পিন্টুর ছেলেবেলাতেই তাঁর বাবা-মা মারা যান। তারপর থেকে মামার বাড়িতেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। এলাকাতেই তাঁদের মামা-ভাগ্নের পান-বিড়ির গুমটি।

মৃত পিন্টু বারিক

এ দিন দোকানের মালপত্র কিনতেই তিনি মোটরবাইকে বিষ্ণুপুরে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। অনিলবাবু বলেন, ‘‘দু’বছর বয়স থেকে আমি ভাগ্নেকে কাছে রেখে মানুষ করেছি। বিষ্ণুপুর থেকে বাজার করে ফিরছিল। কিন্তু কি যে হয়ে গেল!’’ গলা ধরে আসে তাঁর। এক পড়শি বলেন, ‘‘ছেলেটা দু’বছর বয়স থেকেই এখানে আছে। ওদের বাড়ি গড়বেতার কাছে কদমডিহায়। খুব মিশুকে ছিল। যেন আমরা সবাই ওর আপনজন। ভাবতে খারাপ লাগছে ওই মিষ্টি মুখটা আর দেখা যাবে না।’’ এ দিন বিকেলে বিষ্ণুপুর হাসপাতালের মর্গেও দেখা গেল পিন্টুর দেহ ঘিরে এলাকাবাসীর ভিড়। চোখের জল বাধা মানছে না তাঁদের।

বিষ্ণুপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ট্রাকের চালক ও খালাসিকে। জরুরি বিভাগে পড়েছিল ট্রাকচালকের দেহ। তাঁর দেহের পাশেই শুয়েছিলেন খালাসি রাজেশ কর্মকার। তিনি তখনও চালকের মৃত্যুর খবর পাননি। রক্তাক্ত শরীরে কোনও রকমে শুধু বলেন, ‘‘গড়বেতায় মালপত্র নামিয়ে পানাগড়ে ফিরছিলাম। কী করে যে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না।’’ পাশেই পড়ে ট্রাকচালক জয়প্রকাশ যে মারা দিয়েছেন, রাজেশকে তা তখনও কেউ জানায়নি। রাজেশ জানতে চান, ‘‘আমার ড্রাইভার দাদা ভাল আছে তো! নড়াচড়া করছে না কেন?’’ ভিড়ের চিৎকারে হারিয়ে যায় তাঁর বাকি প্রশ্নও।

Accident Deceased body
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy