Advertisement
E-Paper

মাধ্যমিকে ফের চমক বাঁকুড়ার

জঙ্গলমহলের এই জেলা মাধ্যমিকের ফলে বরাবরই চমক দেয়। এ বারও সেই ট্র্যাডিশন বজায় রাখল বাঁকুড়া। অনেক রেকর্ড ভেঙে মেধা তালিকায় প্রথম দশ জনের মধ্যে ১৪ জনই এই জেলার! কৃতীদের মধ্যে ১১ জন বাঁকুড়া শহরের। ন’জন আবার বাঁকুড়া জেলা স্কুলেরই ছাত্র। অন্য দু’জন দক্ষিণ বাঁকুড়ার খাতড়া এলাকার। আর এক জন কোতুলপুরের।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০২:২৪
জেলা স্কুলের কৃতীরা। সুরজিৎ লোহার, শুভজিৎ মণ্ডল, শুভদীপ সিংহ মহাপাত্র, ঋত্বিক রাজ দাস, জয়প্রকাশ বিট, কিশলয় মণ্ডল, তুফান চট্টোপাধ্যায়, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ন্ত সিংহ মহাপাত্র। —নিজস্ব চিত্র।

জেলা স্কুলের কৃতীরা। সুরজিৎ লোহার, শুভজিৎ মণ্ডল, শুভদীপ সিংহ মহাপাত্র, ঋত্বিক রাজ দাস, জয়প্রকাশ বিট, কিশলয় মণ্ডল, তুফান চট্টোপাধ্যায়, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়ন্ত সিংহ মহাপাত্র। —নিজস্ব চিত্র।

জঙ্গলমহলের এই জেলা মাধ্যমিকের ফলে বরাবরই চমক দেয়। এ বারও সেই ট্র্যাডিশন বজায় রাখল বাঁকুড়া। অনেক রেকর্ড ভেঙে মেধা তালিকায় প্রথম দশ জনের মধ্যে ১৪ জনই এই জেলার! কৃতীদের মধ্যে ১১ জন বাঁকুড়া শহরের। ন’জন আবার বাঁকুড়া জেলা স্কুলেরই ছাত্র। অন্য দু’জন দক্ষিণ বাঁকুড়ার খাতড়া এলাকার। আর এক জন কোতুলপুরের।

মাধ্যমিকে রাজ্যে প্রথম হয়েছে বাঁকুড়া জেলা স্কুলের ছাত্র সুরজিৎ লোহার (৬৮৪)। চতুর্থ স্থানে আছে ওই স্কুলেরই ছাত্র শুভজিৎ মণ্ডল (৬৮০)। ষষ্ঠ স্থানেও জেলা স্কুলের দু’জন— শুভদীপ সিংহ মহাপাত্র (৬৭৮) ও ঋত্বিক রাজ দাস (৬৭৮)। সপ্তম স্থানে জেলা স্কুলের জয়প্রকাশ বিট, কিশলয় মণ্ডল ও তুফান চট্টোপাধ্যায়। এদের প্রাপ্ত নম্বর ৬৭৭। অষ্টম স্থানে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (৬৭৬)। দশম হয়েছে জয়ন্ত সিংহ মহাপাত্র(৬৭৪)।

এই ন’জনেরই নিজেদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। শুক্রবার স্কুলে মার্কশিট নিতে এসে সুরজিৎ, শুভদীপ, জয়প্রকাশরা জানাচ্ছিল তাদের বন্ধুত্বের কথা। তারা ন’জনই প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য আলাদা করে টিউশন পড়ত স্কুলেরই শিক্ষকদের কাছে। একে অপরকে টপকে যাওয়ার প্রতিযোগিতা এদের মধ্যে ছিল। কিন্তু, তা কখনওই তাদের বন্ধুত্বে চিড় ধরায়নি। নিজেদের মধ্যে সহায়ক বই বিনিময় করে তারা পড়াশোনা করেছে। কেউ টিউশনিতে না এলে তাকে নোটস দিয়ে সাহায্য করেছে অন্যেরা। প্রতি মাসে টিউশনির ক্লাসে নেওয়া হত পরীক্ষা। তবে তাদের কথায়, “ওই পরীক্ষাগুলোয় আমাদের কোনও প্রতিযোগিতা থাকত না। সবাই পরস্পরকে সাহায্য করেই পরীক্ষা দিতাম।”

স্কুলের পরীক্ষাগুলিতে কিন্তু ছিল চাপা লড়াই। এক সঙ্গে পাশাপাশি বসার জন্য হুড়োহুড়ি চলত ক্লাসে। জয়প্রকাশ বলে, “আসলে আমরা একটা গ্রুপ ছিলাম। টিফিনে এক সঙ্গে খেলতাম। স্কুল ছুটির আগে অনেক বার বাড়িও চলে গিয়েছি এক সাথে।’’ বিনায়ক, জয়ন্ত, শুভদীপদের কথায়, “স্কুলে আমরা সবাই খুব মজা করতাম। শিক্ষকেরা এটাই বলতেন, খোলা মনে পড়াশোনা করো। স্কুল বা টিউশনি সব জায়গাতেই আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকে বাড়তি সাহায্য পেয়েছি।’’

বাঁকুড়া জেলা স্কুলে ফল প্রকাশের দিন। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

এরা সকলেই অন্তত ছ’ঘণ্টা করে বাড়িতে পড়েছে। তবে টেস্টের পরে পড়ার সময় আনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল সুরজিৎ। তাতে নম্বরও বেড়েছে অনেকটাই। সুরজিৎ বলে, “ভাল রেজাল্ট হবে সেটা জানা ছিল। তবে রাজ্যে প্রথম হব, এতটা আশা করিনি।’’ টিভিতে সেই ‘অপ্রত্যাশিত’ খবর দেখার পরেই তাই চমকে গিয়েছিলেন সুরজিতের বাবা, বাঁকুড়া জেলা পূর্ত দফতরের কর্মী প্রশান্ত লোহার, মা দীপালিদেবী, ঠাকুমা লুধু লোহার। পড়শিরাও সকাল থেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন বাড়িতে। অভিনন্দনের ফোন ধরতে ধরতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন দীপালিদেবী। তাঁর কথায়, “খুব খুশি হয়েছি। জীবনে এত আনন্দ পাব ভাবিনি।’’ স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে বিশেষ শুভেচ্ছা নেওয়ার পরে সুরজিৎ বলে, “এখনও মনে হচ্ছে পুরোটাই স্বপ্ন! স্কুলের শিক্ষকদের বড় অবদান রয়েছে এই সাফল্যের পিছনে। আমার বন্ধুরাও ভাল ফল করেছে।’’ অঙ্ক তার প্রিয় বিষয় হলেও ভবিষ্যতে সে ডাক্তার হতে চায়। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে শুভজিৎ, শুভদীপ, ঋত্বিকরাজ, জয়প্রকাশ, কিশলয়, বিনায়ক, জয়ন্তরাও। তবে, তুফানের ইচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ভবিষ্যতে পড়ার। মার্কশিট হাতে নেওয়ার পরে স্কুল ছাড়ার আগেও এই ন’জন এক সঙ্গে। এক এক জনের নামে তারা চিয়ার্স দিচ্ছিল। সুরজিতের নাম দিয়ে যা শুরু হয়ে শেষ হল জয়ন্তের নামে।

এ বার জেলা স্কুলের ১১৫ জন পরীক্ষার্থীর সকলেই উত্তীর্ণ হয়েছে। ৪০ জন ছাত্র ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। এ হেন সাফল্যের রসায়ন কী? স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক রক্তিম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “স্কুলের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র তৈরি করার সময়েও আমরা নানা চিন্তাভাবনা করি। প্রতিটি পরীক্ষাকে খুব গুরুত্ব দিই। আমাদের লক্ষ্য এমন প্রশ্নপত্র তৈরি করা, যাতে স্কুলের ছেলেদের বুদ্ধি প্রয়োগ করে তার উত্তর দিতে হয়।’’

এখানকার ছাত্রদের মধ্যে জানার আগ্রহও চোখে পড়ার মত বলে দাবি করছেন তিনি। টিচার-ইন-চার্জ কৃষধন ঘোষ বলেন, “আমি এর আগে বহু স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। তবে, এখানকার ছাত্রদের জিজ্ঞাসা অনেক বেশি।’’ এ দিন জেলা স্কুলে ছাত্র ও শিক্ষকদের অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “বাঁকুড়া জেলা স্কুল গোটা দেশে এই জেলার অন্যতম পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা আমাদের গর্বের বিষয়।’’

তবে, শুধুই জেলা স্কুল নয়। মেধা তালিকায় ছাপ ফেলেছে বাঁকুড়া শহরের মিশন গার্লস হাইস্কুল ও কেন্দুয়াডিহি হাইস্কুল। মিশন গার্লস থেকে রাজ্যের মেধা তালিকায় অষ্টম স্থানে রয়েছে অঙ্কিতা শিট (৬৭৬)। কেন্দুয়াডিহি হাইস্কুলের ছাত্র অরিত্র মণ্ডল (৬৭৪) দশম স্থান পেয়েছে মেধা তালিকায়। অঙ্কিতা জেলার মেয়েদের মধ্যেও সম্ভাব্য প্রথম। সব বিষয়ে টিউশনির পাশাপাশি বাড়িতেও রুটিন মাফিক পড়ত সে। আবৃত্তি ও গান গাইতে ভালবাসে সে। এ ছাড়াও ফাঁকা সময়ে গোয়েন্দা গল্প পড়া তার শখ। অঙ্কিতা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়। তার কথায়, “মেধা তালিকায় থাকার পাশাপাশি জেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হতে পেরে খুব ভাল লাগছে।’’ ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় অরিত্রও।

শহরের পাশাপাশি মাধ্যমিকের রেজাল্টে চমক দিয়েছে খাতড়ার রাজদীপ হাটি ও সুচরিতা মল্লিক। দু’জনেই খাতড়া শিশু নিকেতন-এর পড়ুয়া। তবে এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া যায় না বলে দু’জনেই অন্য স্কুল থেকে পরীক্ষায় বসেছিল। ৬৭৫ নম্বর পেয়ে রাজ্যে নবম হয়েছে রাজদীপ। স্কুলের পাশাপাশি প্রত্যেকটি বিষয়ে আলাদা করে টিউশন পড়ত সে। এ ছাড়া বাড়িতে নিয়ম করে চার ঘণ্টা পড়া। ক্রিকেট ও ফুটবল খেলতে ভালবাসে রাজদীপ। আর হবি হল গল্পের বই পড়া। রাজদীপ বলে, “ছোট থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। তাই বিজ্ঞান নিয়েই পড়ব।’’

কেচন্দা বিপিএ বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছিল সুচরিতা। ৬৭৪ পেয়ে দশম স্থানে। তার কথায়, “বাবা-মা ও আমার শিক্ষকদের সাহায্যে এই সাফল্য এসেছে।’’ সে-ও ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। বিষ্ণুপুর মহকুমার কোতুলপুর হাইস্কুলের শুভেন্দু প্রামাণিক (৬৭৪) সুচরিতার সঙ্গে যুগ্ম ভাবে সম্ভাব্য দশম স্থান পেয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকতে ভালবাসে শুভেন্দু। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প তার খুব ভাল লাগে। তিনটি টিউশন পড়ত শুভেন্দু। এ ছাড়াও স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকেও আলাদা করে সাহায্য নিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়তে চায় শুভেন্দুও।

Bankura 14 students forest Jangal Mahal BPA ankita shit khatra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy