Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

খাদানের ট্রাক, ডাম্পার জরিমানা করেই ৪৫ কোটি

অবৈধ ভাবে পাথর বোঝাই করে নিয়ে আসা ট্রাক, ডাম্পার থেকে জরিমানা নিয়ে চলতি অর্থবর্ষে এখনও পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা তুলেছেন তাঁরা। বীরভূম প্রশাসনের আশা, এই অর্থবর্ষের শেষে টাকার অঙ্ক পৌঁছতে পারে ৮০ কোটিতেও।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৫৮
Share: Save:

সরকারি ফরমান না মেনেই বীরভূমের বিভিন্ন প্রান্তে পাথর খাদান চলছে বলে অভিযোগ। কিন্তু সেখান থেকে মিলছে না রাজস্ব।

সে কারণে ঘুরপথ ধরেছেন প্রশাসনের কর্তারা।

অবৈধ ভাবে পাথর বোঝাই করে নিয়ে আসা ট্রাক, ডাম্পার থেকে জরিমানা নিয়ে চলতি অর্থবর্ষে এখনও পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা তুলেছেন তাঁরা। বীরভূম প্রশাসনের আশা, এই অর্থবর্ষের শেষে টাকার অঙ্ক পৌঁছতে পারে ৮০ কোটিতেও।

প্রশাসনিক সূত্রে খবর, আগে খাদান থেকে পাথর তোলার অনুমোদন পেতে আবেদন করতে হতো জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে। তার পর রাজ্য সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের অনুমোদন সাপেক্ষে ‘পারমিট’ মিলত। ৫ হেক্টর বা সাড়ে ১২ একরের কম জমি থেকে পাথর উত্তোলন করতে হলে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতাও ছিল না।

পরিস্থিতি বদলায় গত বছর জানুয়ারি মাসে। পরিবেশ আদালত নির্দেশ দেয়— বালি, পাথর, মোরাম তুলতে গেলে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র লাগবে। গত ২৯ জুলাই প্রশাসনিক তরফে আরও একটি নির্দেশ জারি করা হয়। তাতে বলা হয়েছিল— সরকারি শর্ত পূরণ করে মোটা টাকার বিনিময়ে ‘ই-অকশন’ প্রক্রিয়ায় সামিল হতে হবে। তার ভিত্তিতেই মিলবে পাথর খাদানের লিজ। সে সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় নোটিস জারি করে বেশির ভাগ পাথর খাদান বন্ধের নির্দেশ দেয় বীরভূম জেলা প্রশাসন।

প্রশাসনিক সূত্রে খবর, জেলার পাঁচামি, শালবাদারা, রামপুরহাট, নলহাটি শিল্পাঞ্চলের ২১৭টি খাদানের মধ্যে খাতায়-কলমে মাত্র ৬টি খাদান থেকে পাথর উত্তোলনের ছাড়পত্র রয়েছে। বাকিগুলি সরকারি ভাবে বন্ধ। বন্ধ থাকার কথা ১ হাজার ১৬৭টি পাথর ভাঙার কলও (ক্রাসার)।

কিন্তু বাস্তবে ছবিটা অন্য।

অভিযোগ, সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে কাজ চলছে ‘বন্ধ’ অনেক খাদানে। প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ তা মেনেছেন। তাঁদের বক্তব্য, জেলার পাথর খাদানগুলির প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিতে রয়েছে। জটিলতা সেখানেই। কারণ খনিজ সম্পদে সরকারের অধিকার থাকলেও, ব্যক্তিগত জমি খাদানের জন্য নিলামে তোলার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, পাথর শিল্পাঞ্চল বন্ধে শক্তিপ্রয়োগ করলে কয়েক লক্ষ মানুষ কর্মহীন হবেন। তাতে ছড়াতে পারে উত্তেজনা। প্রশাসন তা-ই এ নিয়ে এখনই কড়া পদক্ষেপ করতে চাইছে না। কিন্তু পাথর শিল্পাঞ্চলে কাজকর্ম হলেও সরাসরি সেখান থেকে রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। তাই অবৈধ খাদানের পাথরবোঝাই ট্রাক, ডাম্পারের কাছ থেকে জরিমানা তুলেই ‘ক্ষতিপূরণ’ করতে চাইছেন জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের আধিকারিকরা।

কিন্তু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে আপত্তি তুলেছেন ক্ষুব্ধ ট্রাক, ডাম্পার মালিকরা। তাঁদের প্রশ্ন— কাগজ-কলমে ‘বন্ধ’ রয়েছে জেলার পাথর শিল্পাঞ্চলের ৯০ শতাংশ খাদান। কিন্তু আড়ালে সব কিছু আগের মতোই চলছে। তা হলে অবৈধ কারবারের সঙ্গে যুক্ত খাদান ও পাথর ভাঙার কল মালিকদের ছাড় দিয়ে জরিমানার নামে প্রশাসন কেন ট্রাক, ডাম্পারের উপর জুলুম করছে?

বীরভূমের অতিরিক্ত জেলাশাসক তথা জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অবৈধ ভাবে খনিজ (এ ক্ষেত্রে পাথর) বহন করলে, সমপরিমাণ দ্রব্যের রাজস্বের চেয়ে ১০ গুণ বেশি জরিমানা আদায় করা যায়। সেই নিয়ম মেনে টাকা নেওয়া হচ্ছে। কোনও ভাবে জুলুমের প্রশ্নই ওঠে না।’’ জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রে খবর, আগে এ নিয়ে এত কড়াকড়ি ছিল না। অবৈধ পাথর খাদান থেকে আসা ট্রাক, ডাম্পারের উপর নজরদারির জন্য চেকগেট তৈরি হওয়ার পরই আপত্তি উঠছে। অবৈধ খাদান বা পাথরকল মালিকদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ কেন করা হচ্ছে না? সেই প্রশ্নে অবশ্য প্রশাসনিক কর্তারা সরাসরি কোনও কথা বলতে চাননি। তাঁদের একাংশ সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আইনি জটিলতার কারণ তুলে ধরেছেন।

প্রশাসনিক সূ্ত্রে হিসেব মিলেছে, অবৈধ খাদান থেকে পাথরবোঝাই করে আসা গাড়িগুলি থেকে জরিমানা তুলে কার্যত অনেক বেশি লাভ হয়েছে সরকারের। ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত অর্থবর্ষগুলিতে পাথর খাদান থেকে আদায় হওয়া রাজস্বের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২০.২, ১৩.৬৬, ২১.৭২, ৩৫.৩১ এবং ১২.৬ কোটি টাকা। প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, নজরদারির অভাবে আগে প্রচুর রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।

তালবাঁধ পাথর খাদান মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রকাসিন্ধু সরকারের কথায়, ‘‘জরিমানা করে বেশি টাকা আদায় হলেও এটা সঠিক পথ নয়। এতে পরিবহণ ব্যবসা প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারকে সুষ্ঠু সমাধানসূত্র খুঁজে বের করতে হবে।’’ একই বক্তব্য বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার রবীন সোরেনের। তিনি বলছেন, ‘‘জরিমানা করে নয়, প্রশাসনকে আইনের পথেই পরিস্থিতি সামলাতে হবে।’’

এ বিষয়ে জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, ‘‘অবৈধ কারবারে কাউকে ছাড় দেওয়া বা কারও উপরে জুলুমের ইচ্ছা প্রশাসনের নেই। পাথর শিল্পাঞ্চলে অচলাবস্থা কাটাতে কয়েকটি পদক্ষেপের প্রস্তাব শিল্প ও বাণিজ্য দফতরে পাঠানো হয়েছে।’’ প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, পাথরের জন্য খাস ও অব্যবহৃত জমির নিলাম, খাদান থাকা কোনও ব্যক্তিগত জমি থেকে বছরে বড় অঙ্কের রাজস্ব নেওয়ার মতো প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রশাসনের আশা, সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে এ নিয়ে সবুজ সঙ্কেত মিললে পাথর শিল্পাঞ্চলের সমস্যা অনেকটাই মিটবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Penalty Illegal Dumpers Truck Stones
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE