ব্লক অফিসের বাইরে চলছে তৃণমূলের বিক্ষোভ। অফিসের ভিতরে তখন বিডিও (ইনসেটে)।—নিজস্ব চিত্র।
শাসকদলের নেতাদের সাথে প্রশাসনিক আধিকারিকের বিবাদের ঢেউ গড়াল বোরোতেও। বুধবার মানবাজার ২ বিডিও (ব্লক সদর বোরোয়) পার্থ কর্মকারকে সরানোর দাবিতে ব্লক অফিসের সামনে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সারাদিন বিক্ষোভ অবস্থান জারি রাখলেন।
ইতিপূর্বে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের একাংশের সাথে বিবাদের জেরে পুরুলিয়া ২ ব্লকের মহিলা বিডিও ঘেরাও হয়েছিলেন। সম্প্রতি আড়শার যুগ্ম বিডিও-কে মারধরের অভিযোগ ওঠে ওই পঞ্চায়েত সমিতির এক কর্মাধ্যক্ষের স্বামীর বিরুদ্ধে। তিনি পুলিশে অভিযোগ করায়, সেই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গত সোমবার ব্লক অফিস চত্বরেই তৃণমূল নেতা-কর্মীরা অবস্থান-বিক্ষোভ দেখান। তার একদিন পরেই এ বার বোরোয় বিডিও-কে সরানোর দাবি তুললেন সেই শাসকদলের লোকজনই।
এ দিন বিক্ষোভ দেখানোর জন্য মানবাজার ২ ব্লক অফিসের সামনে রীতিমত ম্যারাপ বাঁধে তৃণমূল। গাড়িতে দলীয় ঝান্ডা বেঁধে কর্মীদের নিয়ে আসা হয়। দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে বোরো বাজারে মিছিল করেন। প্ল্যাকার্ডে ‘মানবাজার ২ ব্লকের অপদার্থ স্বৈরাচারী বিডিও-র অপসারণ চাই’, ‘দুর্ব্যবহারকারী বিডিও দূর হটো’, ‘উদ্ধত বিডিওকে অবিলম্বে সরাতে হবে’ ইত্যাদি স্লোগান লেখা ছিল। ব্লক অফিসের একেবারে সামনে মঞ্চ বেঁধে চেয়ার পাতা হয়েছিল। দফায় দফায় মাইকে কর্মীরা স্লোগান দিচ্ছিলেন। ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে জেলাশাসকের নির্দেশে মহকুমাশাসক (সদর) সৌম্যজিৎ দেবনাথ বিকেলের দিকে বোরোয় আসেন।
বিডিওর বিরুদ্ধে শাসক দলের এমন রোষ কেন?
তৃণমূলের মানবাজার ২ ব্লকের সভাপতি প্রভাস মণ্ডল অভিযোগ করেন, ‘‘পার্থবাবু এই ব্লকে যোগ দেওয়ার পর থেকেই উদ্ধত আচরণ করে যাচ্ছিলেন। সাধারণ মানুষের সাথে তিনি ভাল করে কথা বলেন না। কথায় কথায় পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখান। উনি এই চত্বরে উপরতলায় থাকেন। কিন্তু দুপুর ১২টার আগে তিনি অফিসে ঢোকেন না। জরুরি প্রয়োজনে সাধারণ মানুষ দেখা করতে গেলে তিনি উপর থেকে বলে দেন, দেখা হবে না। অন্যদিন আসতে হবে। এমনকী শনি, রবিবার ছুটির দিনে তিনি কারও ফোন পর্যন্ত ধরেন না।’’
তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে বিডিও-র সংঘাত চূড়ান্ত আকার নেয় গত ২ জুলাই। সে দিন তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের পক্ষ থেকে কর্মীরা বিডিওকে স্মারকলিপি দিতে এসেছিলেন। অভিযোগ বিডিও স্মারকলিপি নিতে অস্বীকার করায় দলের ব্লক সভাপতি প্রভাসবাবু ও জেলা কমিটির সম্পাদক শ্রীপতি মাহাতো বিডিওর চেম্বারে ঢোকেন। শ্রীপতিবাবু আবার মানবাজার ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি গীতা মাহাতোর স্বামী। শ্রীপতিবাবুর অভিযোগ, ‘‘আমরা বিডিওকে স্মারকলিপি নিতে অনুরোধ জানাতে গিয়েছিলাম। উল্টে তিনি হঠাৎ মেজাজ হারিয়ে আমাকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বেরিয়ে যেতে বলেন। নিরাপত্তা রক্ষীকে দিয়ে আমাদের বাইরে বের করে দেওয়া হয়।’’ দুই নেতার সংযোজন, বিডিও তাহলে সাধারণ মানুষের সাথে কেমন ব্যবহার করেন এতেই বোঝা যায়।
বিডিওর সাথে তৃণমূল নেতৃত্বের সংঘাত নতুন নয়। প্রায় এক বছর আগে স্বনির্ভর দলের মহিলাদের নিয়ে একটি কমিটি গড়া হচ্ছিল। সেই কমিটিতে কে কে থাকবেন তা নিয়ে দলের সাথে মতান্তর হয় তাঁর। তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, ব্লকের যুগ্ম বিডিও মহিলাদের গায়ে হাত তুলেছেন। উল্টে যুগ্ম বিডিওর অভিযোগ ছিল, দলের কর্মীরা তাঁকে শারীরিক ভাবে হেনস্থা করেছেন। অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের জেরে শাসক দল ও বিডিওর মধ্যে সংঘাত বাধে। এই অভিযোগে বিডিও এক মহিলা-সহ ন’জন স্থানীয় নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। ওই মামলা পুরুলিয়া আদালতে এখনও চলছে। সে বার ব্লকের বিভিন্ন দফতরের কর্মীরা যুগ্ম বিডিওর হেনস্থার প্রতিবাদে মিছিল করেছিলেন। দলের অভিযোগ বিডিও তাঁর প্রভাব খাটিয়ে ওই সময় সরকারি কর্মীদের দিয়ে মিছিল করিয়েছিলেন।
মানবাজার ২ ব্লকের তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের অভিযোগ, পছন্দ না হওয়ায় বিডিও কয়েকজন অস্থায়ী কর্মীকে সরিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে নিজের স্ত্রীকে দিয়ে পুরস্কারও দেওয়ান। মাঝেমধ্যে সরকারি গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যান বলেও তাঁদের অভিযোগ।
এ দিন ব্লক অফিসের গেটে কড়া পাহারা ছিল। বোরো থানার ওসি অভিজিৎ সিংহ নিজে নিরাপত্তার তদারকিতে ছিলেন। ভিতরে দেখা যায় বিডিও পার্থবাবু নিজের চেম্বারে একা বসে আছেন। মিছিলে এবং স্থানীয় নেতৃত্বের তোলা অভিযোগ নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে। আমি সকালে ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় কাজ দেখতে বের হই। তাই অফিসে আসতে দেরি হয়। ওইদিন শ্রীপতিবাবুর সঙ্গে মোটেই খারাপ ব্যবহার করিনি। অন্য যা অভিযোগ করা হয়েছে, তাও ঠিক নয়।’’
এ দিন সন্ধ্যা নাগাদ মানবাজার ২ যুগ্ম বিডিওর চেম্বারে মহকুমাশাসক, বিডিও এবং তৃণমূলের জেলা নেতা নবেন্দু মাহালি ও স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে আলোচনা হয়। নবেন্দুবাবু বলেন, ‘‘বিডিও বৈঠকে জানিয়েছেন, সে দিনের ব্যবহারে কেউ আহত হলে তিনি দুঃখিত। সবাইকে নিয়ে তিনি উন্নয়নের কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন।’’ যদিও সন্ধ্যায় বিডিও-কে ফোন করা হলে তিনি ধরেননি। জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার জন্য মহকুমাশাসককে আমি পাঠিয়েছিলাম। আলোচনা ভাল ভাবে হয়েছে। এক পরিবারে থাকলে একটু ঠোকাঠুকি হতেই পারে। বিডিওকে বলেছি সবাইকে নিয়ে কাজ করতে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy