Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রশ্ন জেলা হাসপাতালে

ইঞ্জেকশন দিচ্ছে কেন শিক্ষানবীশ

দুপুর ১টা। বিষ্ণুপুর সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল পুরুষ মেডিসিন বিভাগ। কাজে থাকা নার্সরা টেবিলে খোশ গল্পে মত্ত। ১২০ নম্বর বিছানার এক রোগীর ইসিজি করছেন কানে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে থাকা সেই কৃত্তিবাস মুখাজ্জি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্যারামেডিকেল বৃত্তিমূলক শাখার দুই ছাত্রী ।

বিতর্কিত: চিকিৎসাধীন রোগীকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছে এক প্যারামেডিক্যাল পড়ুয়া। নিজস্ব চিত্র

বিতর্কিত: চিকিৎসাধীন রোগীকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছে এক প্যারামেডিক্যাল পড়ুয়া। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৭ ০০:৫০
Share: Save:

দৃশ্য ১: সোমবার সকাল ১০টা ৫০। বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের জরুরি বিভাগ টুলে পাশাপাশি বসে দুই নার্স। টেবিলের উল্টো দিকে চিকিৎসক। একজন রোগী এলেন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জেকশন দিতে বললেন। নার্সরা নয়, এগিয়ে এলেন কৃত্তিবাস মুখার্জ্জি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্যারামেডিকেল বৃত্তিমূলক শাখার প্রশিক্ষণরত এক ছাত্রী। কালক্ষেপ না করে রোগীর শরীরে তিনি ফুঁড়ে দিলেন ইঞ্জেকশন।

দৃশ্য ২: দুপুর ১টা। বিষ্ণুপুর সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল পুরুষ মেডিসিন বিভাগ। কাজে থাকা নার্সরা টেবিলে খোশ গল্পে মত্ত। ১২০ নম্বর বিছানার এক রোগীর ইসিজি করছেন কানে মোবাইল নিয়ে কথা বলতে থাকা সেই কৃত্তিবাস মুখাজ্জি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্যারামেডিকেল বৃত্তিমূলক শাখার দুই ছাত্রী ।

সোমবার এই চিত্র দেখে রোগীর আত্মীয়েরা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। নিমতলা থেকে নিতাই লোহার, বাঁধগাবা গ্রাম থেকে সঞ্জয় রায়রা প্রশ্ন তোলেন— ‘‘হচ্ছে টা কী? নার্সরা বসে গল্প করছেন, আর মাধ্যমিক দিয়ে প্যারামেডিকেল কোর্স করতে আসা শিক্ষানবীশ মেয়েগুলিকে দিয়ে ইঞ্জেকশন দেওয়াচ্ছেস ইসিজি করাচ্ছেন! প্যারামেডিক্যালের শিক্ষানবীশদের এই কাজের অধিকার রয়েছে কি?’’

বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রমেন্দ্রনাথ প্রামাণিক বলেন, ‘‘ওঁদের শুধু রোগীদের চিকিৎসা পর্যবেক্ষণ করার অনুমতি দেওয়া রয়েছে। কিন্তু রোগীদের চিকিৎসা তাঁরা মোটেই করতে পারেন না। অনেক দিন ধরে এ নিয়ে অভিযোগ আসছে। আমি নিজে সুপারকে বহুবার সতর্ক করেছি। কোনও কাজ হয়নি।’’

বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের সুপার পৃথ্বীশ আকুলি বলেন, ‘‘ওঁদের শুধু পর্যবেক্ষণ করার অনুমতি রয়েছে। রোগীকে ইঞ্জেকশন দেওয়া বা ইসিজি প্রভৃতির জন্য পর্যাপ্ত নার্স রয়েছে এখানে।’’ তাঁর আশ্বাস, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তাহলে প্যারামেডিক্যাল পড়ুয়ারা কার কথায় ওই কাজ করছেন? তাঁদের দাবি, বৃত্তিমূলক শাখার ইন্সট্রাক্টর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক শুভাশিস হাজরা পড়ুয়াদের রোগীদের ইঞ্জেকশন দেওয়া-সহ টুকটাক কাজ হাতে-কলমে শিখে নিতে বলেছেন। যদিও শুভাশিসবাবু সব শুনে তাজ্জব। তাঁর দাবি, ‘‘ইঞ্জেকশন দেওয়া বা ইসিজি করতে তো বলা হয় নি! ওঁদের শুধু পর্যবেক্ষণে পাঠানো হয়েছে। কোনও রোগীর বিপদ হলে কে দায় নেবে? ওঁদের ডেকে সমঝে দেব।’’ যদিও হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে আসা লোকজনের দাবি, শুধু এ দিনই নয়, অনেক দিন ধরেই প্যারামেডিক্যালের পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে রোগীদের চিকিৎসায় হাত লাগানোর অভিযোগ উঠছে। কিন্তু কেউ তা আটকাননি।

এই চাপানউতোরের মধ্যে অন্য প্রশ্নও উঠেছে। হাসপাতালের নার্স বা ডাক্তাররা কেন প্যারামেডিক্যালের পড়ুয়াদের বাধা দেননি? নার্সদের প্রশ্ন করে জবাব মেলেনি। তবে এক বিশষজ্ঞ চিকিৎসকের দাবি, ‘‘ওঁদের তো কোথাও এই সব কাজ শিখতে হবে। কারণ আগামী দিনে তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় এই সব কাজ করবেন। চিকিৎসা ব্যবস্থায় তাঁদের ভূমিকা রয়েছে।’’ কিন্তু কোনও রোগীর বিপদ হলে? চিকিৎসকের জবাব, ‘‘সেটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।’’ তবে ঘটনার কথা জেনে কৃত্তিবাস মুখার্জ্জি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ পাত্র বলেছেন, ‘‘ছ’মাসের কোর্স। তার মধ্যে হাসপাতালে রোগীদের পরীক্ষা করার কথা নয়।’’

ঘটনাচক্রে, এ দিনই বিজেপি-র বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলার পক্ষ থেকে বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের নানা অব্যবস্থা ও ডেঙ্গি নিয়ে শহর জুড়ে মিছিল করে বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলা আধিকারিকের অফিসে বিক্ষোভ দেখান। বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, ‘‘রোগীরা কি পুতুল? প্রাণ চলে গেলে দায় কে নেবে?’’

বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির বাঁকুড়া জেলাশাসকের মনোনীত সদস্য প্রাক্তন শিক্ষক হরিপ্রসন্ন মিশ্রও বলেন, ‘‘এ তো রোগীর জীবন নিয়ে ছেলেখেলার সামিল। ওঁদের তো প্রশিক্ষণও শেষ হয়নি। এতে জনমানসে ভুল বার্তা যাবে। দ্রুত এ সব বন্ধ হওয়া দরকার।’’ বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন, ‘‘অনেক হয়েছে। এ বার কড়া পদক্ষেপ করা হবে। সরাসরি স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি দিয়ে সব জানাচ্ছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE