Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Asha Worker

Asha Worker: ‘সাহায্য চাইলে কী করে না করি!’

বছরখানেক আগের ঘটনা। কাশীপুর লাগোয়া ন’পাড়া এলাকায় একটি দেশি মদের দোকান খোলার তোড়জোড় ঘিরে গোল বাঁধে।

অর্চনা খাঁ। নিজস্ব চিত্র

অর্চনা খাঁ। নিজস্ব চিত্র

প্রশান্ত পাল 
কাশীপুর শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২১ ০৯:৪৫
Share: Save:

পেশায় তিনি আশাকর্মী। তবে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে স্বাস্থ্য-পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি, মহিলাদের সামাজিক নানা সমস্যায় মুশকিল আসান হয়ে উঠেছেন পুরুলিয়ার কাশীপুরের সকলের ‘আশা দিদি’ অর্চনা খাঁ।

বছরখানেক আগের ঘটনা। কাশীপুর লাগোয়া ন’পাড়া এলাকায় একটি দেশি মদের দোকান খোলার তোড়জোড় ঘিরে গোল বাঁধে। লোকালয়ের মধ্যে মদের দোকান খোলা নিয়ে ইতিউতি জটলায় আপত্তি উঠলেও আলোচনাতেই তা গুটিয়ে যাচ্ছিল। তার পরে, হঠাৎই এক দিন দেখা গেল, রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছেন শতাধিক মহিলা। মুখে স্লোগান—এলাকায় মদের দোকান খোলা চলবে না। সম্মিলিত প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে মিলল পুলিশের আশ্বাস। রুখে গেল মদের দোকানের দরজা খোলা। সে দিনের সে সম্মিলিত প্রতিবাদের নেপথ্যে ছিলেন অর্চনা।

অর্চনার কথায়, “এলাকার অনেক বাড়িতেই স্বামীরা রোজগারের একটা বড় অংশ মদে উড়িয়ে বাড়ি এসে অত্যাচার করত। ছোট শিশুর সামান্য দুধও জুটত না। অনেক মেয়েই এসে কান্নাকাটি করত। তাই প্রতিবাদ তো করতেই হত।“ এলাকায় ঘুরেও শোনা গেল, মদের ঠেকে ঠেকে এর পরে অভিযানের পরে, বাড়ির মেয়েদের উপরে নির্যাতন অনেকটা কমেছে।

তবে শুধু মদের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। অর্চনার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নারী বাহিনী কাশীপুর-সহ লাগোয়া এলাকার মহিলাদের নানা সমস্যায় এগিয়ে আসছেন। দলের এক সদস্য দীপিকা রানা জানাচ্ছিলেন, কয়েক মাস আগে পুঞ্চা থানার বাসিন্দা এক তরুণী বধূ রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে যান। শ্বশুরবাড়ির তরফে কোনও সদুত্তর না পেয়ে তরুণীর বাবা তাঁদের সাহায্য চান। তার পরে, তরুণীর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শুরু হয় খোঁজ-খবর। তবে লাভ না হওয়ায় শেষমেষ পুলিশের দ্বারস্থ হন তাঁরা।

অর্চনার কথায়, “পরে জানা গিয়েছিল, শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি বাড়ি থেকে পালিয়ে রেললাইনে ঝাঁপ দিতে যায়। কয়েক জনের চোখে পড়ায় তাঁরাই মেয়েটিকে বাঁচান। সে এখন বাপের বাড়িতে রয়েছে।” ওই তরুণীর মা-ও বলেন, “সে সময়ে আমাদের যা অবস্থা ছিল, অর্চনা-সহ ওখানকার মেয়েরা সাহায্য না করলে, মেয়েকে হয়তো ফিরেই পেতাম না।”

আর এ সবের মাঝেই চলে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের লক্ষ্যে গর্ভবতীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, প্রসূতি ও নবজাতকের খোঁজ নেওয়া, পোলিও খাওয়ানোর মতো নানা কাজ। মাঝে করোনা-পর্বে জুড়েছে দলে থাকা মেয়ে ও এলাকার তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে নিয়ে কোভিড-আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা, নিভৃতবাসে থাকা মানুষজনের কাছে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার মতো কাজও।

কী করে এত কিছু সামলান? অর্চনা হেসে বলেন, “বাড়ি বাড়ি ঘোরার সুবাদে কখন যে তাঁদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছি, জানি না। স্বাস্থ্য পরিষেবার কাজ রয়েইছে। তবে মেয়েরা তাঁদের সমস্যা জানিয়ে সাহায্য চাইলে কী করে না করি বলুন?”

আর এই সহমর্মিতার পাঠ যেন জীবনই দিয়েছে তাঁকে। জানালেন, বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম বনফুসড়ায় প্রাথমিকের পড়াশোনা তাঁর। তবে গাঁয়ে হাইস্কুল না থাকায় সাইকেলে জঙ্গলের রাস্তা ধরে ফি দিন চার কিলোমিটার দূরে জোড়দা গ্রামে যেতে হত। বিয়ের পরেও পড়াশোনায় ইতি টানতে দেননি। ছেলের সঙ্গে ওই একই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। পরবর্তীতে, সমাজবিদ্যায় সাম্মানিক স্নাতক হয়েছেন। অর্চনা বলেন, “দরকারে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়, এটা আলাদা করে কখনও ভাবিনি। গ্রামে বেড়ে উঠেছি। তাই আপনা থেকেই সে বোধ তৈরি হয়ে গিয়েছে।”

কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুপ্রিয়া বেলথরিয়াও বলেন, “স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার সঙ্গে অর্চনা ও ওঁর সঙ্গীরা নানা সামাজিক কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন। অসহায় মেয়েদের সমস্যায় পাশে থাকছেন। ওঁদের সাধুবাদ জানাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Asha Worker
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE