Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ছাই নেবে কে, তাকিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র

উন্নয়নের চাকাটা গড়াতে শুরু করলেও পথ এখনও বাকি। ফলে সাঁওতালডিহির বদলাতে শুরু করা আর্থ-সামাজিক ছবিটা অসম্পূর্ণই রয়ে গিয়েছে।এলাকায় এখন কান পাতলেই শোনা যায়, উন্নয়নের বৃত্তটা পুরোপুরি সম্পূর্ণ হয়নি।

বিদ্যুৎকেন্দ্র ঝলমলে।

বিদ্যুৎকেন্দ্র ঝলমলে।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
সাঁওতালডিহি শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

উন্নয়নের চাকাটা গড়াতে শুরু করলেও পথ এখনও বাকি। ফলে সাঁওতালডিহির বদলাতে শুরু করা আর্থ-সামাজিক ছবিটা অসম্পূর্ণই রয়ে গিয়েছে।

এলাকায় এখন কান পাতলেই শোনা যায়, উন্নয়নের বৃত্তটা পুরোপুরি সম্পূর্ণ হয়নি। সাঁওতালডিহি বিদ্যুৎকেন্দ্র বা ভোজুডি কোল ওয়াশারি দু’টি ক্ষেত্রেই ছবিটা একই। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে মূল সমস্যাটা অনুসারী শিল্প গড়ে না ওঠা। যার নিট ফল উন্নয়ন থমকে গিয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দু’টি ভারী শিল্প থাকা সত্ত্বেও কর্মসংস্থান, ব্যবসা-সহ সার্বিক আর্থিক উন্নয়ন চাইছে পুরুলিয়ার প্রাচীন শিল্প শহর সাঁওতালডিহি।

বস্তুত সাঁওতালডিহির ক্ষেত্রে অনুসারি শিল্প গড়ে না ওঠায় আবার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই সমস্যায় ভুগছে এই থানার অর্ন্তগত চেলিয়ামা, জোরাডি দুই পঞ্চায়েতের ছয়-সাতটি গ্রাম। বাসিন্দাদের অভিযোগ, ছাই উড়ে পরিবেশ দূষিত করছে। তাই ছাই সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাইছে ইছড়, কামারগোড়া, উপরডি, নবগ্রাম, আগুইট্যাঁড়, কুমোরডি, পড়াডিহার বাসিন্দারা। তাঁদের মতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাইকে ঘিরে এলাকায় অনুসারী শিল্প গড়ে না উঠলে ছাই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব নয়।

কী ভাবে ছাই নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে গ্রামের বাসিন্দাদের? সমস্যাটা দু’ধরনের। প্রথমত বগড়া গ্রামের অদূরে ছাই পুকুর থেকে ডাম্পারে ছাই নিয়ে যাওয়ার সময় সঠিক পদ্ধতি না মানায় এলাকায় ছাই উড়ছে বলে অভিযোগ। সেই সঙ্গে ভারী মাল নিয়ে গাড়ি যাতায়াতে রাস্তাও ভাঙছে। দ্বিতীয়ত গোয়াই নদী পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডের দামোদরপুর গ্রামের অদূরে ফাঁকা জায়গায় ছাই স্তূপ করা হচ্ছে। কিন্তু বাসিন্দাদের অভিযোগ জোরে হাওয়া দিলেই ছাই উড়ে আশপাশের গ্রামে পড়ছে।

ইছড়ের প্রকাশ মাজি, নবগ্রামের ভূতনাথ রায়, কুমোরডির অমৃত মাহাতো, পড়াডিহার উত্তম পান্ডে, আগুইট্যাঁড়ের জগন্নাথ কুম্ভকারদের কথায়, ‘‘নিয়ম অনুযায়ী ছাই জমিতে ফেলার পরেই মাটি চাপা দিতে হবে। কিন্তু তা সময় মতো করা হয় না। তাই জোরে হাওয়া দিলেই ছাই উড়ে পড়ছে ঘরের উঠোনে, বাড়ির ছাদে।’’

বস্তুত বর্ষার সময়টা বাদ দিয়ে বছরভরই এই সমস্যায় ভুগতে হয় বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। তাঁদের অভিজ্ঞতা, ‘‘বিশেষ করে গরমের সময়ে প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। জোরে হাওয়া দিলে বা কালবৈশাখী হলেই ছাই উড়ে পড়ে গ্রামে। ঢেকে যায় রাস্তা ঘাট, বাড়ি সবকিছু। ছাইয়ের দাপটে ঘণ্টাখানেক বাড়ির বাইরে বেরতে পারেন না লোকজন।’’ তাঁদের অভিযোগ, বিভন্ন সময়ে প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে ছাই দূষণের প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু প্রতিকার মেলেনি। তাঁরা চান, এ বার ছাই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হোক।

ছাইপুকুরের দূষণ নিয়ে বিরক্ত বাসিন্দারা।

এই প্রসঙ্গেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাইকে কেন্দ্র করে সাঁওতালডিহি বা পাশের এলাকায় অনুসারী শিল্প গড়ে না ওঠা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই সিমেন্ট ও ইট তৈরিতে কাজে লাগে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, বর্তমানে ৫ ও ৬ নম্বর ইউনিট দু’টি থেকে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন হচ্ছে। তাই ছাইয়ের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু সিমেন্ট বা ইট তৈরির কারখানাগুলি সেই ছাই নিতে এগিয়ে না আসায় সঙ্কট কাটছে না।

গত চার বছরে সাঁওতালডিহিতে কী পরিমাণ ছাই তৈরি হয়েছে আর সেই তুলনায় কী পরিমাণে ছাই অনুসারী শিল্পগুলি নিয়েছে তার পরিসংখ্যানেই পরিষ্কার। বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, গত আর্থিক বছরে (২০১৪-২০১৫) বিদ্যুৎকেন্দ্রে ছাই তৈরি হয়েছে ৮.৪ লক্ষ মেট্রিক টন। সেখানে সিমেন্ট, অ্যাসবেসটর্স বা ইট তৈরির কারখানাগুলি ছাই নিয়েছে ১৩,৩২৮ টন। শতকরা হিসাবে মাত্র ১.৫৮ শতাংশ। তার আগের বছরে ছাই জমা পরে ৫.৮ লক্ষ মেট্রিক টন। কারখানাগুলি ছাই নিয়েছে ১২,২৪৪ টন। শতকরা হিসাবে ২.০৮ শতাংশ। গত চার বছরে ছাই তৈরি হয়েছে কমবেশি ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন.আর বিভিন্ন কারখানা ছাই নিয়েছে মাত্র ৩৫ হাজার ৮৯৬ মেট্রিক টন। শতকরা হিসাবে গড়ে দেড় শতাংশের কাছাকাছি ছাই নিয়েছে কারখানাগুলি।

পিডিসিএলের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘বিভিন্ন সমস্যা মিটিয়ে গত চার বছর ধরে সাঁওতালডিহির দু’টি ইউনিট পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন শুরু করেছে। ফলে স্বভাবতই ছাই বেশি তৈরি হলেও ছাইয়ের ক্রেতা নেই এলাকায়। ফলে সমস্যাটা বাড়ছে।” এই অবস্থায় পিডিসিএল চাইছে এলাকায় ছাই ইট তৈরির কারখানা গড়ার বিষয়ে উদ্যোগী হোক প্রশাসন। ওই আধিকারিক বলেন, “নিয়ম অনুযায়ী ইট তৈরির কারখানাগুলিকে আমরা উৎপাদিত ছাইয়ের ২০ শতাংশ বিনামূল্যে দেব। কিন্তু এলাকায় হাতেগোনা ছাই ইটের কারখানা রয়েছে। এলাকায় বড় মাপের ফ্লাই অ্যাশের সিমেন্ট কারখানাও নেই।’’

বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে সাঁওতালডিহিতে গত চার দশকে অনুসারী শিল্প গড়ে না ওঠায় এক দিকে যেমন ছাই নিয়ে দূষণের সমস্যা তৈরি হয়েছে, তেমনিই কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বগড়া গ্রামের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ৭০-এর দশকে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে জমি দিয়ে স্থায়ী চাকরি পেয়েছিলেন গ্রামের ২০০ জন। এখন এই গ্রামে বিদ্যুৎকেন্দ্রে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা মোটে চার জন। দু’বছর পরে তাঁরা অবসর নিলে সংখ্যাটা দাঁড়াবে শূন্যে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫ ও ৬ নম্বর ইউনিট দু’টি তৈরির সময়ে নির্মাণকাজে যুক্ত হয়েছিলেন এলাকার প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক। নির্মাণ শেষ হলে তাঁরা কাজ হারিয়েছেন। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যাটা কমবেশি ৮৫০।

এই প্রেক্ষিতেই এলাকায় প্রশ্ন উঠছে, কেন চার দশকে সাঁওতালডিহি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে অনুসারী শিল্প গড়ে তোলা হল না? বগড়া গ্রামের যুবক রাজেশ চৌধুরী, পড়াডিহার বিক্রম মাহাতারা বলেন, ‘‘বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজের সুযোগ কমছে.অথচ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে অনুসারী শিল্প তৈরি হলে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হতো। প্রশাসন বা জনপ্রতিনধিরা এ দিকটা নজর দিলে এলাকায় বেকার সমস্যা এতটা তীব্র হতো না।’’ সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার দাবি করেছেন, ‘‘এক সময়ে ক্রমাগত লোকসানে চলা সাঁওতালডিহিকে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। আমরাই উদ্যোগী হয়ে নতুন দু’টি ইউনিট তৈরি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বাঁচিয়েছি।’’

তৃণমূলের রঘুনাথপুর ২ ব্লক সভাপতি বরুণ মেহেতাও স্বীকার করছেন, ‘‘৫ ও ৬ নম্বর ইউনিট দু’টির নির্মাণকাজ শেষের পরে কর্মসংস্থানের একটা দাবি ক্রমশই জোরালো হচ্ছে সাঁওতালডিহিতে। বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলেন, ‘‘আমরা রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে সাঁওতালডিহি ঘিরে অনুসারী শিল্প হিসাবে ছাই ইটের কারখানা, সিমেন্ট কারখানা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি। কিন্তু রাতারাতি সেটা সম্ভব নয়, সময় লাগবে।”

ছবি: প্রদীপ মাহাতো ও নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ash Santaldih Santaldih thermal power
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE