জঙ্গলমহলের ব্লক রাইপুরের তৃণমূল নেতা অনিল মাহাতো খুনের ঘটনার তদন্তে নতুন মোড়। ওই খুনের ঘটনার পরে নিহত নেতার যে অনুগামী খুনিদের ধরার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছিলেন রাইপুর ব্লকের যুব তৃণমূল সভাপতি রাজকুমার সিংহ। এ বার তাঁর ভাই সনৎ সিংহকেই অনিল-খুনে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করল পুলিশ! একই সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন অনিলবাবুর গাড়ির চালক জগন্নাথ নামাতা। যিনি নিজেকে ওই খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছিলেন। ধৃত দু’জনকেই বৃহস্পতিবার খাতড়া আদালতে তোলা হলে ১২ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ হয়।
তদন্তকারীদের দাবি, খুনের ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত সনৎ ও জগন্নাথ। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কিছু তথ্য-প্রমাণও পুলিশের হাতে এসেছে। তবে, তদন্তের স্বার্থে এখনই বিশদে কিছু বলছে না জেলা পুলিশ। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা শুধু বলেছেন, “ধৃতদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আরও তথ্য জানার চেষ্টা করব আমরা। তদন্ত চলছে।’’
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে রাইপুরের মটগোদায় তৃণমূল পার্টি অফিসের সামনে দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে খুন হন ব্লক তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি অনিলবাবু। অনিলবাবু এলাকায় জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তাঁর খুনে গোটা রাইপুর অশান্ত হয়ে ওঠে। অনিলবাবুর ঘনিষ্ঠ অনুগামী হিসেবে পরিচিত রাজকুমার এই খুনের জন্য অভিযোগের আঙুল তোলেন অনিল-বিরোধী হিসেবে পরিচিত রাইপুর ব্লক তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি জগবন্ধু মাহাতোর গোষ্ঠীর লোকজনের বিরুদ্ধে। নিহত নেতার স্ত্রী ও বর্তমানে ব্লক তৃণমূলের সভাপতি সুলেখা মাহাতো জগবন্ধবাবুর ঘনিষ্ঠ ৭ জন দলীয় নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে রাইপুর থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে রাইপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ এবং বেশ কিছু অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি ছিলেন।
পুলিশ যাতে অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতার করে, সেই দাবিতে পথে নামেন রাজকুমার সিংহ। তাঁর অনুগামীরা পুলিশের বিরুদ্ধে এলাকায় পোস্টারও সাঁটান। এরই মাঝে রাইপুরে অনিলবাবুর বাড়িতে আসেন যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেকের সামনেই জগবন্ধুবাবুর ঘনিষ্ঠ খাতড়ার তৃণমূল নেতা তথা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ শ্যামল সরকারের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে রাজকুমারের অনুগামীদের বিরুদ্ধে। অনিলবাবুর বাড়িতে দাঁড়িয়েই অভিষেক পুলিশকে নির্দেশ দেন খুনিদের তিন দিনের মধ্যে গ্রেফতার করার। এর পর পরই এফআইআরে নাম থাকা সাত জনকে ধাপে ধাপে ধরে পুলিশ। তদন্ত অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। কারণ, এই খুনের পিছনে আপাত না-দেখা আরও কিছু কারণ থাকতে বলে প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল তদন্তকারীদের।
পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, সনৎ ও জগন্নাথকে মঙ্গলবার বাঁকুড়ায় ডেকে পাঠিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করে রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ। কোনও রকম ঝামেলা এড়াতে এ দিন খাতড়া আদালতে ধৃতদের হাজির করানোর আগে বড় পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ধৃতদের কোর্টে পেশ করে দ্রুত গাড়িতে তুলে নিয়ে বাঁকুড়ার উদ্দেশে রওনা দেয় পুলিশের জিপ।
তবে, এই জোড়া গ্রেফতারির খবর ছড়িয়ে পড়তেই নানা জল্পনা শুরু হয়েছে রাইপুরের আনাচে কানাচে। ঘটনা হল, অনিলবাবু খুন হওয়ার সময় তাঁর সঙ্গেই ছিলেন গাড়ির চালক জগন্নাথ। অনিলবাবুর স্ত্রী সুলেখাদেবী জানিয়েছিলেন, ঘটনার পরে জগন্নাথই তাঁকে প্রথম ফোন করে হামলার খবর দেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পুলিশের সামনে বয়ানও দেন জগন্নাথ। যদিও তাঁর বয়ানে প্রথম থেকেই অসঙ্গতি ধরা পড়েছিল পুলিশের নজরে। তাঁর নিহত স্বামীরই ঘনিষ্ঠ দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে শুনে সুলেখাদেবীর প্রতিক্রিয়া, “আমি কলকাতায় রয়েছি। বিষয়টি জানা নেই। পুলিশের তদন্তে আমার ভরসা রয়েছে। প্রকৃত দোষীদের শাস্তি চাই।’’ অন্য দিকে, রাইপুরের যুব নেতা রাজকুমার বলেন, “অনিলদাকে আমার ভাই খুন করেছে, এটা আমি কোনও দিন বিশ্বাস করব না। অনিলদার একনিষ্ঠ অনুগামী ছিল সনৎ। পুলিশ চক্রান্ত করে ওকে ফাঁসাচ্ছে। সঠিক তদন্ত হচ্ছে না।’’
অনিল-খুনের তদন্তে সিআইডি-কে কাজে লাগানোর দাবি তুলছিলেন রাইপুর ব্লক তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি জগবন্ধুবাবু। এ দিন তিনি বলেন, “প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল, সর্ষের মধ্যেই ভূত থাকতে পারে! গোষ্ঠী বিবাদের জেরে অনিল খুন হয়নি, মানুষের সামনে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। যাদের এই ঘটনায় ফাঁসিয়ে আগেই গ্রেফতার করানো হয়েছে, তাঁরা কতটা দোষী, সেটাও রাইপুরবাসীর কাছে পরিষ্কার
হয়ে গিয়েছে।’’ জেলা সভাধিপতি তথা তৃণমূলের জেলা সহ সভাপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “অনিল আমাদের দলের সম্পদ ছিলেন। পুলিশ যাতে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার করে,
সেটাই চাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy