Advertisement
E-Paper

বাড়ি থাকতেও কারও শিশুদিবস কাটল হোমে, কারও দিন কাটল আনন্দে

একটি বা দু’টি ঘটনা নয়, গত দু’মাসে এই রকম উদ্ধার করা আটটি ছেলেমেয়ের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় হওয়ার পরেও তৎক্ষণাৎ তাদের পরিজনদের হাতে তুলে দেওয়া যায়নি। জেলার বাসিন্দা হলেও, তাদের আরও কিছু দিন কাটাতে হয়েছে জেলারই হোমে।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:২৭
আকাশ-ছুঁতে: প্রচার ট্যাবলোর উদ্বোধনে পুরুলিয়ার জেলাশাসক। বুধবার। নিজস্ব চিত্র

আকাশ-ছুঁতে: প্রচার ট্যাবলোর উদ্বোধনে পুরুলিয়ার জেলাশাসক। বুধবার। নিজস্ব চিত্র

ঘটনা ১: ফোন পেয়ে সাঁতুড়ির বাড়ি ছেড়ে আদ্রায় প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এসেছিল বছর সতেরোর কিশোরী। কিন্তু প্রেমিক আসেনি। রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে কিশোরীকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে পুলিশ উদ্ধার করে তাকে। তারপরে চাইল্ডলাইন। ২০ অক্টোবরের সেই রাতেই কিশোরীর বাড়িল লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আদ্রার চাইল্ডলাইন। পরের দিনই মেয়েকে ফেরাতে আদ্রায় চলে আসেন পরিজনেরা। কিন্তু, পুরুলিয়া জেলায় শিশু কল্যাণ সমিতি না থাকায় উদ্ধারের ১২ দিন পরে কিশোরীকে পরিবারের হাতে দিতে পেরেছে চাইল্ডলাইন। বারোটা দিন ওই কিশোরীকে কাটাতে হয় পুরুলিয়া শহরের আনন্দমঠ হোমে।

ঘটনা ২: পড়াশোনা নিয়ে বাবা বকাবকি করায় অভিমানে ঘর থেকে পালিয়েছিল ঝালদার বেঙ্গু গ্রামের বছর পনেরোর কিশোর অমিত মাহাতো। ট্রেনে চেপে চলে আসে আদ্রায়। সন্দেহজনক ভাবে তাকে স্টেশনে ঘুরতে দেখে উদ্ধার করে রেলপুলিশ। সেখান থেকে চাইল্ডলাইনের হাতে। গত সোমবারের ঘটনা। খবর পেয়ে অমিতের বাবা পঙ্কজ মাহাতো মঙ্গলবারই আদ্রায় আসেন। কিন্তু ততক্ষণে বিষ্ণুপুরের সুমঙ্গলম হোমে অমিতকে শিশু কল্যাণ সমিতির কাছে পেশ করতে পৌঁছে গিয়েছিলেন চাইল্ডলাইনের কর্মীরা। সমিতির নির্দেশের এক সপ্তাহ তার ঠাঁই হয়েছে আদ্রার মণিপুরের হোমে। তার আগে বাড়ি ফেরানোর উপায় নেই।

একটি বা দু’টি ঘটনা নয়, গত দু’মাসে এই রকম উদ্ধার করা আটটি ছেলেমেয়ের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় হওয়ার পরেও তৎক্ষণাৎ তাদের পরিজনদের হাতে তুলে দেওয়া যায়নি। জেলার বাসিন্দা হলেও, তাদের আরও কিছু দিন কাটাতে হয়েছে জেলারই হোমে। কেন এমনটা হচ্ছে, বুধবার শিশু দিসবে এই প্রশ্ন উঠেছে জেলার বিভিন্ন মহলে।

পুরুলিয়া জেলায় শিশু কল্যাণ সমিতি না থাকাতেই এই সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছে চাইল্ডলাইন ও জেলা শিশু সুরক্ষা সমিতি। জানা গিয়েছে, গত আড়াই বছর ধরেই পুরুলিয়ায় শিশু কল্যাণ সমিতি নেই। সমিতি গঠন নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলায় স্থগিতাদেশ ছিল আদালতের। তত দিন এই বিষয়টি দেখতেন জেলাশাসক ও মহকুমাশাসকেরা। আদালতের স্থগিতাদেশ উঠলেও এখনও বহু জেলায় সমিতি গঠন হয়নি। সেই প্রেক্ষিতে মাস দুয়েক আগে বীরভূমের শিশু কল্যাণ সমিতিকে পুরুলিয়ার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, তাতেও জট খোলেনি।

কারণ, বীরভূমের শিশু কল্যাণ সমিতির ঘাড়ে রয়েছে আরও সাত জেলার অতিরিক্ত দায়িত্ব। জেলাগুলি হল: পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া। বীরভূমের শিশু কল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন শাশ্বতী সাহা জানান, এই মুহূর্তে তাঁকে আটটি জেলা দেখতে হচ্ছে। সময়ের অভাবে তিনি সপ্তাহে এক দিন করে একএকটি জেলার গিয়ে একাধিক জেলার কাজকর্ম দেখেন। যেমন, প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার বিষ্ণুপুরের হোমে গিয়ে তিনি পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলার কাজকর্ম পরিচালনা করেন।

পুরুলিয়ার শিশু সুরক্ষা সমিতির আধিকারিক শিশির মাহাতো ও চাইল্ডলাইনের আদ্রার কর্মকর্তা মন্টু মাহাতো জানান, এই জেলায় শিশু কল্যাণ সমিতি না থাকায় উদ্ধার করা ছেলেমেয়েদের বাড়ি ফেরাতে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তাঁরা জানাচ্ছেন, ছেলেমেয়ে উদ্ধারের খবর পেয়ে চাইল্ডলাইনের সাবসেন্টারে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছেন অবিভাবকেরা। কিন্তু, আইনের জটিলতায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের হাতে উদ্ধার করা ছেলেমেয়েকে তুলে দেওয়া যাচ্ছে না। সে জন্য প্রায়শই চাইল্ডলাইনের কর্মীদের পরিবারগুলির কাছে হুমকি, ধমকও শুনতে হচ্ছে।

মন্টুবাবুর অভিযোগ, ‘‘একবার আসানসোলের তিন বালককে উদ্ধার করে আরপিএফ। খোঁজ নিয়ে তাদের বাড়িতে যোগাযোগ করতেই পরের দিন তাঁরা আদ্রায় চলে আসেন। কিন্তু, সমিতির সামনে তাদের পেশ না করে পরিজনদের দেওয়া যায়নি। সে জন্য পরের দিন থেকে ফোনে ওই এলাকার লোকের কাছে হুমকি, ধমক শুনতে হয়েছিল।’’ অনেক ক্ষেত্রেই হোমের নানা অব্যবস্থার অভিযোগ ওঠে। তাই সেখানে ঘরের ছেলেমেয়েরা রয়েছে শুনে স্বস্তি পান না অভিভাবকেরা। এ ক্ষেত্রে নিজেদের অসহায়তার কথা স্বীকার করে মন্টুবাবু বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েগুলির বাড়ির খোঁজ পেলেই আমরা তাদের দ্রুত ফেরানোর চেষ্টা করি। কিন্তু, শিশু কল্যাণ সমিতির নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত নিয়ম অনুযায়ী তাদের হোমেই রাখতে হবে।”

নিয়মটা কী? চাইল্ডলাইন সূত্রে খবর, উদ্ধার করা শিশু, কিশোরদের শিশু কল্যাণ সমিতির সামনে হাজির করতে হয়। সেখান থেকে আপাতত হোমে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে শিশু, কিশোরের ঠিকানা পাওয়া গেলে সেখানে গিয়ে সব কিছু খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেবে সমিতি। তারপর নির্দিষ্ট আবেদনপত্র পূরণ করিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে ফের ওই শিশুকে সমিতির কাছে পেশ করা হবে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে সমিতি সন্তুষ্ট হলে শিশুটিকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেবে।

আগে জেলায় জেলায় শিশু কল্যাণ সমিতি থাকায় এই প্রক্রিয়া অনেক সময় এক দিনেই শেষ হত। কিন্তু, এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে অন্তত এক সপ্তাহ। অমিতের বাবা বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েকে খুঁজে পেলে কে আর হোমে রাখতে চায়? মনে হয়, কতক্ষণে তাকে বাড়ি নিয়ে যাব।’’

শাশ্বতীদেবীও নিরুপায়। তিনি বলেন, ‘‘অভিভাবকদের উপস্থিতিতে ছেলেমেয়েগুলির সঙ্গে কথা বলাটা অন্যতম শর্ত। কোনও অত্যাচারে তারা পালিয়েছিল কি না, কিংবা আদৌ তারা ফিরতে চাইছে কি না, এমন কিছু বিষয় দেখতে হয়। সবার উপস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখে নিশ্চিত হওয়ার পরেই আমরা অবিভাবকদের সঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েদের ছাড়ি।’’ তিনি জানান, এক সঙ্গে আটটি জেলার দায়িত্ব থাকায় সপ্তাহে এক দিন এক বা দু’টি জেলার জন্য সময় দেওয়া ছাড়া তাঁরও কোনও উপায় নেই।

Children's Day Children's Day 2018 Adra Shelter Home
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy