Advertisement
২৬ মার্চ ২০২৩

ধর্ষক শ্বশুর এলে পুলিশকে খবর দেব, বলছেন বৌমারাই

সনাতনের এক ছেলে গুজরাটে এবং অন্য ছেড়ে ঝাড়খণ্ডে কর্মসূত্রে থাকেন। গ্রামে ফিরলে তাঁরা অবশ্য আলাদা বাড়িতেই ওঠেন। পড়শিরা জানাচ্ছেন, দুই ছেলের সঙ্গে সনাতনের সম্পর্ক ভাল নয়।

তালাবন্ধ: দরজায় শিশুর ছবি। সেই বাড়ির কর্তার বিরুদ্ধেই শিশু নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। পুরুলিয়ার নদিয়াড়া গ্রামে। ছবি: সুজিত মাহাতো

তালাবন্ধ: দরজায় শিশুর ছবি। সেই বাড়ির কর্তার বিরুদ্ধেই শিশু নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। পুরুলিয়ার নদিয়াড়া গ্রামে। ছবি: সুজিত মাহাতো

প্রশান্ত পাল ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৭ ০২:৩৯
Share: Save:

বাড়ির এক কোণায় একটি ঘরে শুয়ে থাকা পরিচারিকার এক রত্তি মেয়েটাকে ক্রমশ নেতিয়ে পড়তে দেখে ভাগ্যিস বাড়ির বৌমারা জোর করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন। তাই পুরুলিয়া মফস্‌সল থানার নদিয়াড়া গ্রামের ওই সাড়ে তিন বছরের শিশুর উপরে নির্যাতনের ঘটনা সামনে এল। সব জেনে শিউরে উঠছেন ওই গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা ততটাই ক্ষুব্ধ নির্যাতনে অভিযুক্ত গৃহকর্তা সনাতন গোস্বামীর (ঠাকুর) উপরে। সনাতনের বৌমারাও জানিয়েছেন, সে গ্রামে ফিরলে তাঁরাই পুলিশকে খবর দেবেন।

Advertisement

শনিবার সকালে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এক প্রান্তে সনাতনের বাড়ি। আশপাশে তেমন বসতি নেই। সনাতনের ঘরের দরজায় তালা ঝুলছিল। দেব-দেবীর ছবি সাঁটানো দরজার উপরে। খোঁজখবর শুরু করতে একে একে বাসিন্দারা জড়ো হন। জানা যায়, বছর বাষট্টির সনাতন আগে গ্রামে হরিনাম করলেও স্ত্রীর মৃত্যু ও অবসরের পর হঠাৎ করে পুজো-অর্চনায় মেতে ওঠে। গ্রামের লোকেরা সমস্যায় পড়লে সে ঝাঁড়ফুক করে দিত। এমনকী বশীকরণও করতে পারত বলে দাবি করতে সে। কয়েক মাস আগে তার বাড়িতে পরিচারিকার কাজ নিয়ে ওঠেন বছর বত্রিশের এক মহিলা, সঙ্গে তাঁর সাড়ে তিন বছরের ওই মেয়ে। পুলিশের কাছে সনাতনের বিরুদ্ধে সেই বাচ্চাটির উপরে এমন অত্যাচারের খবর শুনে তাজ্জব বাসিন্দারা। এমনটা যে হয়েছে, তাঁরা ঘুণাক্ষরেও তা টের পাননি বলে জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন: ঘুষ নিয়ে ধৃত খনি-কর্তা

সনাতনের এক ছেলে গুজরাটে এবং অন্য ছেড়ে ঝাড়খণ্ডে কর্মসূত্রে থাকেন। গ্রামে ফিরলে তাঁরা অবশ্য আলাদা বাড়িতেই ওঠেন। পড়শিরা জানাচ্ছেন, দুই ছেলের সঙ্গে সনাতনের সম্পর্ক ভাল নয়। শুক্রবার সনাতনের স্ত্রীর বাৎসরিক কাজ ছিল সেই উপলক্ষে দিন দশেক আগে দুই পুত্রবধূ গ্রামে এসেছেন। ছেলেরা অবশ্য আসেননি। বড় পুত্রবধূ রিঙ্কি ঠাকুর ও ছোট পুত্রবধূ রীনা ঠাকুর বলেন, ‘‘এসে থেকেই দেখছি ওই শিশুটি ঘরের মধ্যে নেতিয়ে পড়ে রয়েছে। ওর মা জানিয়েছিল, জ্বর হয়েছে। রবিবার থেকে বলছিলাম, ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু ডাক্তার দেখাতে চাইছিল না। শ্বশুরেরও তেমন গরজ দেখছিলাম না। শেষে পাড়ার কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গাড়ি ভাড়া করে মঙ্গলবার ওদের পুরুলিয়ায় পাঠাই।’’

Advertisement

সেখানকার ডাক্তাররাই চিকিৎসা করতে গিয়ে ওই শিশুর গায়ে অসংখ্য ক্ষত দেখে চমকে যান। মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেন। পরে জানা যায়, দেহের ভিতরেও সাতটি সুচ বিঁধে রয়েছে। দু’টি হাতও ভাঙা। চাইল্ডলাইন বহু চেষ্টা করায় মেয়েটির মা তাঁদের জানান, ওই গৃহকর্তাই তাঁর মেয়েকে অত্যাচার করেছে। কিন্তু কেন করেছে, তা আর কবুল করেননি। শুক্রবার তা জানার পরেই চাইল্ডলাইন থানায় সনাতনের বিরুদ্ধে শিশুটির উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করে। শনিবার নদিয়াড়া গ্রামে গিয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশ।

জেলা জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড ও চাইল্ডলাইনের সদস্য ঝর্না মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিশুটিকে আছড়ানোও হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। দিনের পর দিন এমনটা চলল কী করে, ভেবে পাচ্ছি না।’’ শনিবার পুরুলিয়ার জেলা চাইল্ডলাইনের কো-অর্ডিনেটর দীপঙ্কর সরকার জানান, দেহে সুঁচ ফোটা ও হাত ভাঙার ঘটনাটি জেনে পুলিশের কাছে শিশুটিকে হত্যার চেষ্টার ধারাও যুক্ত করার আবেদন জানাবেন বলে ঠিক করেছেন। বাঁকুড়া মেডিক্যালে শুক্রবার রাতে শিশুটিকে নিয়ে আসা হয়। বাঁকুড়া চাইল্ডলাইনের কো-অর্ডিনেটর সজল শীল জানান, পুরুলিয়া থেকে খবর পেয়ে তাঁরা বাঁকুড়া মেডিক্যালে আগে থেকে সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। ফিমেল সার্জিক্যালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করা হয়।

সনাতন গ্রেফতার না হওয়ায় তাই ক্ষোভে ফুঁসছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। বাঁকুড়া মেডিক্যালের প্রবীণ ডাক্তাররাও স্বীকার করেছেন, এমন অত্যাচারের রোগী তাঁরাও কোনও দিন দেখেননি। সনাতনের বড় পুত্রবধূ রিঙ্কি বলেন, ‘‘শ্বশুর ওই মহিলাকে বাড়িতে তোলার পর থেকেই আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল নয়। কিন্তু শিশুটার উপরে উনি অত্যাচার করেছেন বলে শুনে শিউরে উঠছি। পুলিশ ওঁর খোঁজ করতে এসেছিল। পুলিশকে জানিয়েছি, উনি ফিরলে আমরাই পুলিশে খবর দেব।’’ পড়শি পাগল রায়, চিন্তামণি রায় জানান, গ্রামের একপ্রান্তে সনাতনের বাস বলে সেখানে কী হচ্ছে, তাঁরা জানতে পারতেন না। তাঁদের কথায়, ‘‘দরজায় হাসি মুখের এক শিশুর ছবি সাঁটিয়ে রেখেছে। অথচ সেই লোকই এক শিশুর উপরে পাশবিক অত্যাচার করেছে শুনে তাজ্জব হয়ে গিয়েছি।’’

কিন্তু মেয়ের উপরে অত্যাচার দেখেও তার মা কেন মুখ বুজে ছিলেন, এখনও মুখে কেন কুলুপ, তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছে। বাঁকুড়া মেডিক্যালের ডাক্তাররাও জানিয়েছেন, মায়ের সঙ্গে ওই শিশুর সম্পর্ক তাঁদের স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। শিশুটি ওয়ার্ডের মধ্যে ছটফট করলেও তার মা বার বার ওয়ার্ডের বাইরে যেতে চাইছিলেন। এ দিন তিনি আনন্দবাজারের কাছে দাবি করেছেন, ‘‘মেয়ের শরীরে সুচ বিঁধে রয়েছে বলে জানতাম না। বৈশাখ মাস থেকে মেয়ের পেটে যন্ত্রণা হচ্ছিল। বাড়ির মালিক বলেছিল, ভেড়ার দুধ খাওয়ালে ঠিক হয়ে যাবে। সেই ভরসাতেই ছিলাম।’’ পুলিশ জানাচ্ছে, সব কিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.