ঘুঘুকালী পুজোর তোড়জোড় সোনামুখীতে।— নিজস্ব চিত্র
বাঁকুড়ার সোনামুখী পুর-শহরের মুনসেফগড় এলাকায় বিখ্যাত ঘুঘুকালীর পুজো। আদি ইতিহাস কেউই ঠিক করে বলতে পারেন না। জনশ্রুতি রয়েছে, অনেক কাল আগে খোলা আকাশের নীচে, জঙ্গলের মধ্যে আকড় গাছের ছায়ায় দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আশেপাশে বাসা বাঁধত ঘুঘুপাখি। তার থেকেই দেবীর নাম হয় ঘুঘুকালী। সেই দেবীই এখন সাক্ষাৎ সম্প্রীতির প্রতিমূর্তি। মুনসেফগড় ষোলোআনা কমিটির সম্পাদক অসীম ঘোষ, সদস্য পিরু কারকদের কথায়, “সমস্ত ধর্মের মানুষ এই পুজোয় সামিল হন। মুসলমান ধর্মাবলম্বীরাও আত্মীয়-পরিজনের নামে সংকল্প করে মন্দিরে পুজো দেন। পুজোর পরে পাত পেড়ে ভোগ খাওয়ার সারিতেও কোনও ভেদাভেদ থাকে না।’’ তাঁদের দাবি, শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো দীর্ঘ দিন ধরেই সমন্বয়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে। মুনসেফ গড়ের বাসিন্দা ইদ্রিস আনসারি, জিন্না আনসারি, সেখ হাকিমরা জানান, চাঁদা তোলা, ঘট আনতে যাওয়া, বিসর্জন— সবেতেই তাঁরা থাকেন। ইদ্রিসদের কথায়, ‘‘আমাদের পাড়ার পুজোর ভার আমারা না নিলে আর কে নেবে!”
দুই জেলায় কালীপুজোকে ঘিরে সম্প্রীতির নজির এমন আরও রয়েছে। উৎসব সেখানে পেরিয়ে গিয়েছে ধর্মের গণ্ডী।
কর্মসূত্রে আদ্রায় আসা কয়েকজন রেলকর্মীর হাত ধরে কালীপুজো শুরু হয়েছিল আদ্রায়। তাঁদের কেউই এখন সেখানে থাকেন না। কিন্তু এখনও প্রতি বছর পুজো হয় সমস্ত আচার মেনে। সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাপসকুমার হালদার আর আমির হোসেনরা। আদ্রার ডেমোক্র্যাট ন্যাশনাল ক্লাবের কালীপুজোর কমিটিতে সদস্য রয়েছেন পনেরো জন। তার মধ্যে সাত জন মুসলিম। এক জন খ্রিস্টান— রাহুল কিরো। সবাই এক সঙ্গে চাঁদা তুলতে বেরোন। প্রসাদ বিতরণ পর্যন্ত সমস্ত কাজ করেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। পুজো কমিটির সভাপতি রেলকর্মী তাপসবাবু জানান, গত বছরও পুজোয় সবচেয়ে বেশি চাঁদা দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী শেখ কালিমুদ্দিন।
কমিটির সদস্যেরা জানান, বছর বত্রিশ রেল শহর আদ্রার চার্চপাড়ায় এ ভাবেই পুজো করে আসছে ক্লাবটি। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা সুবল কর্মকার জানান, আশির দশকের গোড়ায় ক্লাবটি তৈরি হয়। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা সুবল কর্মকার জানান, সেই সময় এলাকায় পরপর কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতি হয় রেলের পদস্থ আধিকারিক মতিলাল নাথের বাড়িতে। রেল ও পুলিশের উদ্যোগে গড়ে ওঠে রাত পাহারার দল। সেই সূত্রেই ক্লাবের পত্তন। পুজো শুরু হয় তারও বেশ কিছুটা পরে। ১৯৮৪ সালে। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মতিলালবাবুই।
পুজো কমিটির সদস্যেরা জানান, বিশাল মাপের পুজো হয় না। কিন্তু অন্য পুজোর জাঁকজমককে কয়েক গোলে হারিয়ে দেয় আমির হোসেন, মহম্মদ শাহনওয়াজ ও অন্য যুবকদের আন্তরিকতা আর উদ্যম। পুজোর সময় কম করে শ’দুয়েক মানুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক সঙ্গে পাত পেড়ে বসেন। খিচুড়ি, সব্জি, পায়েস খাওয়া হয় জমিয়ে। বালতি হাতে পরিবেশনে হাত লাগান শাহনওয়াজরা। পুজো কমিটির সহ-সভাপতি পেশায় আরপিএফ কর্মী কার্তিকচন্দ্র পাল বলেন, ‘‘ছোটবেলা থেকেই এমনটা দেখে আসছি। কোনও দিন কোনও ভেদের কথা মনে আসেনি। আমির ও শাহনওয়াজ বলেন, ‘‘ছোট থেকেই একসঙ্গে বড় হয়েছি সবাই মিলে। আমরাও পুজোর আনন্দের ভাগ পেতে পারি না— তাও কি হয়!’’
কালী পুজোর পরের দিন পুঞ্চার চরণপাহাড়ি কালী মন্দিরের পুজোয় ভোগ খাওয়ার পঙ্ক্তিতেও দীপা সিং সর্দার, অঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়দের পাশে বসেন ফতেমা বিবি, রেহানা খাতুন, সায়রা খাতুনরা। এই পুজোর শুরুটাও অভিনব। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে পুঞ্চা থানায় আধিকারিকের পদে এসেছিলেন জি টি লতিফ। তাঁর উদ্যোগেই চরণপাহাড়ি ডুংরির ওপরে মন্দির তৈরি করে পুজো শুরু হয়। আজও মন্দিরের গায়ে জি টি লতিফের নাম খোদাই করা রয়েছে।
সাত দশক ধরে সম্প্রীতির সেই ঐতিহ্য অটুট রয়েছে। শালপাতার থালায় ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুড়ি আর চাটনি। সমস্ত ধর্মের কয়ের হাজার মানুষ প্রতি বছর চরণপাহাড়ি কালী মন্দিরের পুজোয় আনন্দে সামিল হন। পুজো কমিটিতেও রয়েছেন বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা। পুজো কমিটির কর্তা বঙ্কিম হালদার, অসীম মুখোপাধ্যায়, চিত্ত হালদার, মৃণালকান্তি দত্তরা বলেন, ‘‘এলাকার সবাই আমাদের পাশে দাঁড়াই বলেই এই আয়োজন সম্ভব হয়।’’ পুজো কমিটির সদস্য, একটি রাজনৈতিক দলের নেতা মনসুর আলি বলেন, ‘‘এই পুজো সব অর্থেই সর্বজনীন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy