Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

চেষ্টা সার, গোঁজ-কাঁটা রইলই

গোঁজ-কাঁটা রয়েই গেল তৃণমূলে! পুরভোটের ঠিক আগে হাজার চেষ্টাতেও ঢাকা দেওয়া গেল না দলের ভিতরকার দ্বন্দ্ব। টানা ক’দিন চেষ্টা চালিয়েও বিক্ষুব্ধদের মন গলাতে পারল না তৃণমূল। বুধবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন দলের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ওয়ার্ডেই নির্দল হিসেবে দাঁড়ালেন তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর রেখা দাস রজক-সহ আরও অনেক বিক্ষুব্ধ প্রার্থী। অথচ, রেখাদেবীকে বাঁকুড়া পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী করেছিল দল।

হ্যালো...। নেতা-নেত্রীরা প্রচারে ঝাঁপানোর আগে বাঁকুড়ায় মাইক, মাইক্রোফোন পরীক্ষা করা চলছে।—নিজস্ব চিত্র।

হ্যালো...। নেতা-নেত্রীরা প্রচারে ঝাঁপানোর আগে বাঁকুড়ায় মাইক, মাইক্রোফোন পরীক্ষা করা চলছে।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৫ ০২:১০
Share: Save:

গোঁজ-কাঁটা রয়েই গেল তৃণমূলে! পুরভোটের ঠিক আগে হাজার চেষ্টাতেও ঢাকা দেওয়া গেল না দলের ভিতরকার দ্বন্দ্ব।

টানা ক’দিন চেষ্টা চালিয়েও বিক্ষুব্ধদের মন গলাতে পারল না তৃণমূল। বুধবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন দলের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ওয়ার্ডেই নির্দল হিসেবে দাঁড়ালেন তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর রেখা দাস রজক-সহ আরও অনেক বিক্ষুব্ধ প্রার্থী। অথচ, রেখাদেবীকে বাঁকুড়া পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী করেছিল দল। কিন্তু, রেখাদেবী অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডে নতুন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে বাধ্য হল শাসকদল। বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের কোর-কমিটির সদস্য তথা জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “৫ নম্বরে আমাদের প্রার্থী করা হয়েছে রুমা চক্রবর্তীকে। রেখা দলের বিরুদ্ধে যাওয়ায় ওঁকে আমরা বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

যদিও তৃণমূলে অস্বস্তির এখানেই শেষ নয়। শুধু রেখাদেবীই নন, টিকিট না পাওয়ায় বাঁকুড়া পুরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে সন্তোষ গরাই, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে প্রদীপ বাগদি, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে জিতেন দাস, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিদায়ী কাউন্সিলর বিশ্বজিত্‌ কুণ্ডু, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে রঞ্জিতকুমার মজুমদার নির্দল হিসেবে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এঁরা সকলেই এলাকার সক্রিয় তৃণমূল কর্মী বা নেতা। এই বিক্ষুব্ধেরা যাতে মনোনয়ন জমা না দেন, তার জন্য নানা কৌশল নিয়েছিল তৃণমূল। অথচ বুধবার পর্যন্ত ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রদীপবাবু ছাড়া আর কাউকেই সিদ্ধান্ত থেকে সরানো যায়নি।

তবে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জল্পনা ছিল রেখাদেবীকে নিয়েই। দীর্ঘ ১৫ বছর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি। ওই ওয়ার্ডে তাঁর জনসংযোগও যথেষ্ট। কিন্তু প্রাক্তন পুরপ্রধান শান্তি সিংহের ৭ নম্বর ওয়ার্ড এ বার সংরক্ষণের আওতায় পড়ায় দল তাঁকে ৬ নম্বরে ওয়ার্ডের প্রার্থী করে। রেখাদেবীকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে টিকিট দেওয়া হয়। প্রথম থেকেই রেখাদেবী নিজের ওয়ার্ড ছাড়তে অরাজি ছিলেন। রেখাদেবীকে বোঝাতে মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসেন তৃণমূলের জেলা নেতারা। জেলা পরিষদে সভাধিপতির বিশ্রামকক্ষে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ, বাঁকুড়ার বিধায়ক মিনতি মিশ্র ও সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী কয়েক দফা বৈঠক করেন। কিন্তু শেষ রক্ষে হয়নি। এ দিন রেখাদেবী মনোনয়নপত্র জমা করেছেন সেই ৬ নম্বর ওয়ার্ডেই।

কেন দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেলেন? রেখাদেবীর ক্ষোভ, “দল প্রার্থী তালিকা ঠিক করার আগে আমাকে নিয়ে একবারও বৈঠক করেনি। যদি ভোটের কয়েক মাস আগেও আমাকে জানানো হত, ভেবে দেখতাম। এখন আমি পুরোদমে প্রচার শুরু করে দিয়েছি। আমার পক্ষে আর ওয়ার্ড পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।” একই সঙ্গে তাঁর দাবি, “আমার ওয়ার্ডের মানুষ কোনও ভাবেই আমাকে অন্য ওয়ার্ডে যেতে দিতে নারাজ। এই ওয়ার্ডে আমার জনসংযোগ এমনই যে, প্রচার না করলেও মানুষ আমাকেই ভোট দেবেন।” সভাধিপতি অবশ্য স্পষ্ট বুঝিয়েছেন দলের চেয়ে বড় কেউ নয়। তাঁর কথায়, “দল রেখাকে তৈরি করেছে। দলীয় প্রতীক ছাড়া কেউ-ই কিছুই নয়। যে বেশি আকাশে উড়তে যাবে, সেই দ্রুত মাটিতে পড়বে!”

বস্তুত, ছ’নম্বর ওয়ার্ডে শান্তি সংহ ও চার নম্বর ওয়ার্ডে দেবপ্রসাদ (তারা) কুণ্ডু সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থী। কিন্তু ওই দু’টি ওয়ার্ডেই বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থী দাঁড়িয়ে পড়ায় জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব প্রথম থেকেই ব্যাকফুটে। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল প্রার্থী সন্তোষ গরাইকে অবশ্য তৃণমূল বলে মানতেই নারাজ সভাধিপতি। উল্টে তাঁকে বালি মাফিয়াচক্রে জড়িত বলে ইঙ্গিত করে অরূপবাবু বলেন, “কে সন্তোষ? ওই নামে কোনও তৃণমূল কর্মী ৪ নম্বর ওয়ার্ডে নেই! তবে ওখানে বালি মাফিয়ার একটি চক্র রয়েছে। ওই চক্রের মদতেই নির্দল প্রার্থী হচ্ছে। আমি ওই চক্রকে ভেঙে দিচ্ছি। তা হলেই নির্দল গুটিয়ে যাবে!” শুধু সন্তোষবাবুই নয়, বাঁকুড়া পুরসভার সব নির্দল প্রার্থীর পিছনে কে বা কোন গোষ্ঠী রয়েছে, তা জানতে তাঁরা দলীয় ভাবে খোঁজ নিচ্ছেম বলে জানিয়েছেন অরূপবাবু। সন্তোষবাবুর অবশ্য দাবি, “আমি দীর্ঘদিন ধরে এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের সম্পাদক। আজ দল আমাকে চিনতে পারছে না! বালি মাফিয়া নয়, আমার পিছনে মানুষ রয়েছেন।”

শুধু বাঁকুড়া পুরসভাই নয়। বিষ্ণুপুর পুরসভাতে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কর্মী রাজীবকান্তি (বাপ্পা) রায় দলীয় টিকিট না পেয়ে নির্দল হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মঙ্গলবার তিনি নিজের অনুগামীদের নিয়ে মিছিল করে মহকুমাশাসকের দফতরে গিয়ে মনোনয়ন জমা দেন। এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন অভিজিত্‌ সিংহ। রাজীবের কথায়, “দীর্ঘদিন ধরে দলীয় সংগঠনকে এই ওয়ার্ডে ধরে রেখেছি আমি। কিন্তু, দল আমাকেই টিকিট দিল না। তাই নির্দল হয়ে দাঁড়ালাম।” বিষ্ণুপুরের বিদায়ী পুরপ্রধান তথা রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলে দিয়েছেন, “প্রতীক ছাড়া কোনও প্রার্থীই তৃণমূলের নয়।” সোনামুখী পুরসভাতেও তৃণমূলের বেশ কিছু গোঁজ প্রার্থী নানা ওয়ার্ডে রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। দলীয় ভাবে তৃণমূল যদিও সে কথা মানতে নারাজ। তবে, স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সোনামুখী পুরসভার বিদায়ী বিরোধী দলনেতা সুরজিত্‌ মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও গোঁজ প্রার্থী রয়েছেন। একই ভাবে সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহার ৩ নম্বর ওয়ার্ডেও রয়েছেন গোঁজ প্রার্থী। এ ছাড়াও ১১, ১২ ও ১৫ নম্বরেও বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মীরা নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দীপালিদেবী অবশ্য বলেন, “কোনও বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী নির্দল প্রার্থী হয়েছেন বলে আমার কাছে খবর নেই। তবে ভোট কাটাকাটির জন্য সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেস নিজেদের গোঁজ প্রার্থী দেয় ওয়ার্ডগুলিতে।”

সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তথা জেলা পরিষদের বিরোধী দল নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “পুরসভা ভোটে প্রার্থী বাছাইকে ঘিরে তৃণমূলের যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, এতে আমাদেরই সুবিধা। মানুষ এখন থেকেই টের পাচ্ছেন, তৃণমূল শান্তিপূর্ণ ভাবে পুরসভা চালাতে পারবে না। উন্নয়নের প্রশ্নেও দ্বন্দ্ব বাধবে ওদের।” যা শুনে দীপালিদেবীর পাল্টা, “এ বার সোনামুখী পুরসভা আমরা বিরোধীশূন্য করব। মানুষ উন্নয়ন চায়। যা বামেরা করতে পারবে না। তাই আমাদের প্রার্থীদের উপরেই আস্থা রাখবেন পুরবাসী।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE