Advertisement
E-Paper

যুগের অবসান, রাজা হারাল হেতমপুর

খুব ইচ্ছে ছিল, রথে রশিতে টান দেবেন, দিয়েওছিলেন! বহু কষ্টে রাজবাড়ির দোতলা থেকে নেমে এসেছিলেন রথের রশিতে হাত ছোঁওয়াবেন বলেই! এই তো সে দিন! বন্ধ হয়ে যাওয়া রথের সংস্কারের পর এ বছরই, উদগ্রীব অপেক্ষার শেষে হাত দিয়েছিলেন রথের রশিতে।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ০০:৪০
বাড়ির অন্দরে স্বমহিমায় মাধবীরঞ্জন চক্রবর্তী। (ডান দিকে) এই জুলাইয়ে রথের দিন রাজাকে দেখতে ভিড়। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় ও নিজস্ব চিত্র।

বাড়ির অন্দরে স্বমহিমায় মাধবীরঞ্জন চক্রবর্তী। (ডান দিকে) এই জুলাইয়ে রথের দিন রাজাকে দেখতে ভিড়। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় ও নিজস্ব চিত্র।

খুব ইচ্ছে ছিল, রথে রশিতে টান দেবেন, দিয়েওছিলেন!

বহু কষ্টে রাজবাড়ির দোতলা থেকে নেমে এসেছিলেন রথের রশিতে হাত ছোঁওয়াবেন বলেই! এই তো সে দিন!

বন্ধ হয়ে যাওয়া রথের সংস্কারের পর এ বছরই, উদগ্রীব অপেক্ষার শেষে হাত দিয়েছিলেন রথের রশিতে। সে দিন অবশ্য নব কলেবরে রথ নয়, ‘রাজা’-কে দেখতেই ভিড় উপচে উঠেছিল জীর্ণ রাজবাড়ির সামনে।

রবিবার সেই রাজারই চলে যাওয়ার খবর এসে পৌঁছতে শোক ছড়াল হেতমপুরের হাওয়ায়। শোকের ভিড় এসে যেন থমকে দাঁড়াল একলা, জীর্ণ রাজবাড়ির চৌকাঠে।

চলে গেলেন হেতমপুরের রাজবাড়ির রাজা মাধবীরঞ্জন চক্রবর্তী।

রবিবার দুপুরে কলকাতার বালিগঞ্জ থেকে তাঁর মেয়ে বৈশাখীর টেলিফোনে মৃত্য সংবাদটা এসে যখন পৌঁছল, তখন নিজের কানকেই ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি পাঁচ পুরুষ ধরে হেতমপুর রাজ পরিবারের ম্যানেজারের দায়িত্ব সামলানো শঙ্কর রায় এবং কর্মী দেবাশিস মুখোপাধ্যায়রা। কেননা, রবিবার সকাল সাড়ে ৯টাতেও রাজা তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। জেনেছেন রাজবাড়ির ছাদ-খিলান, কড়ি-বরগা আর হেতমপুরের কথা!

ভেঙে পড়েছেন শঙ্করবাবু।

কত স্মৃতি, কত দিনের ঘটনার কথা যে এলোমেলো হাওয়ার মতো পাক দিয়ে ফিরে ফিরে ঘুরছে তাঁর স্মৃতিতে। বলছিলেন, ‘‘বুকে সংক্রমণ নিয়ে ভুগতেন বলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে কলকাতায় যেতেন রাজা। রানি মা পূর্ণিমাদেবী পক্ষাঘাতে অসুস্থ। দুই অবিবাহিত মেয়ে অনুরাধা এবং বৈশাখীও বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকেন। কিন্তু উনি হেতমপুর রাজবাড়িতে কাটাতেই ভালবাসতেন। বালিগঞ্জের ছোটবাড়ি আর শহরে যে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসত!’’

কথা ছিল বুধবারই ফিরবেন। কিন্তু ফেরা আর হল কই!

হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, লোক-লস্কর— বীরভূমে হেতমপুর রাজবাড়ির বৈভব ছিল ষাটের দশেকের আগে পর্যন্ত।

সেই জাঁকের কথা মাধবীরঞ্জন যেন কিছুতেই ভুলতে পারতেন না। কেউ গেলে, দিল দরিয়া হয়ে ডেকে ঘুরিয়ে দেখাতেন রাজমহল। ঠাকুর দালান, দক্ষিণের বারান্দা, উত্তরের মহাল, ছাদের সিঁড়ি। যে সিঁড়ি দিয়ে এক ভোরে ক্যামেরা কাঁধে উঠে সত্যজিৎ রায় তুলেছিলেন তাঁর ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর সেই বিখ্যাত গানের দৃশ্য। বলতেন, ছেলেবেলার কালো ঘোড়ার পিঠে চড়ার গল্প, বিখ্যাত সব শিল্পীদের সঙ্গে গিটার বাজানোর গল্প, শুটিংয়ের কথা। আর গল্পের শেষে বাইরের দিকে চেয়ে উদাস হয়ে যেতেন। মুখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবলই বলতেন, ‘সেই দিন আর কোথায়!’

সিলিং বহির্ভূত সম্পত্তি খাস হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বিশেষ করে সত্তরের দশকের পর থেকে ক্রমশ পড়তে থাকে রাজ পরিবারের অবস্থা। তখন থেকেই ভেঙে পড়েন রাজাবাবু। সেই সব দিনের কথা স্মৃতি থেকে বলছিলেন শঙ্করবাবু।

‘‘কী সুপুরুষ চেহারা ছিল রাজা মাধবীরঞ্জনের। ওঁর একটা একটা হাতের কব্জি যেন আমাদের পায়ের সমান মোটা। পাকা আমের মতো রঙ ছিল। মনে আছে, ভাগলপুরে রাজা বিয়ে করতে যাওয়ার সময় গোটা হেতমপুরে যেন উৎসব পড়ে গিয়েছিল। ঘোড়ায় চড়ে যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন, তখন ভিড় উপচে পড়ত।’’ তিনি জানান, বাবা-দাদুদের কাছে শুনেছেন, রাজার বাবা বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তী যখন মারা যান তখন মাধবীরঞ্জন মাত্র বছর ছ’য়েকের শিশু। ওঁকে মানুষ করেন দাদু কমলানিরঞ্জন। রাজার মুখেও শুনেছেন, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই রাজবাড়িতে থেকেই বীরভূমের ইতিহাস লিখেছিলেন। বাড়িতে তখন ছিল জাঁকজমক পূর্ণ!

জৌলুস যত ফিকে হয়েছে, মরমে চূর্ণ হয়েছেন মাধবীরঞ্জন। রাজপাট হারিয়ে অর্থ কষ্টে ভুগতে ভুগতে যে করুণ দশা হয় রাজবাড়ির, তা রাজার ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন। শঙ্করবাবুর বলেন, ‘‘আমার থেকে মাত্র বছর বারো তেরোর বড় ছিলেন রাজা। তাই খুব কাছে থেকে ওঁকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু সাংঘাতিক অর্থকষ্ট শুরু হয়েছিল রাজ পরিবারের। সরকারের দেওয়া বছরে ৯,৮৩৬ টাকা আর সামান্য কিছু জমি জমা বিক্রি করে খুব কষ্টে কাটছিল দিন। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল রাজবাড়ি চত্বরে একটি বেসরকারি বিএএড কলেজ করার জায়গা দেওয়ার পরে। তবে মোটের উপর ভাল অবস্থা ছিল না রাজার!’’

গত রবিবার রাজবাড়ি থেকে কলকাতার বাড়িতে তাঁকে পৌছে দেন যে কর্মীরা, রাজার চলে যাওয়ার খবরে এ দিন দি‌শেহারা তাঁরাও। শোকে ভেঙে পড়েছেন মাধবীরঞ্জনের ছোট মেয়ে বৈশাখী চক্রবর্তী। বলেন, ‘‘বাবা শ্বাসকষ্টজনিত কারণে দিন কয়েক ধরেই ভুগছিলেন। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধও খাচ্ছিলেন। রবিবার দুপুর ১টার সময় হঠাৎ-ই নিথর হয়ে গেলেন। হাসপাতাল বা নার্সিংহোম নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাইনি!’’

দিন ফুরিয়ে অনেকেই এসে ফিরে গেলেন রাজবাড়ির সামনে থেকে। একলা রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রাজাকে ঘিরে তাঁদের মনে গহনে নানা স্মৃতির ধুলো-ঝড়।

রাজা চলে গিয়েছেন!

(সহ-প্রতিবেদন: অরুণ মুখোপাধ্যায়)

King Hetampur Birbhum Arun Mukhapadhya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy