Advertisement
E-Paper

খাবার বাড়তে বলে ফিরলেন না নেতা

ফোনে জানিয়েছিলেন, তিনি বাড়ি ফিরছেন। খাবার সাজিয়ে রাখতে বলেছিলেন স্ত্রীকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফের বেজে উঠেছিল সুলেখাদেবীর ফোন। খবর আসে, তাঁর স্বামী তৃণমূলের রাইপুর ব্লক কার্যকরী সভাপতি অনিল মাহাতো (৪৫) গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:২০
রাইপুরের মটগোদায় তৃণমূলের দলীয় অফিসের সামনে এখানেই চলে গুলি।

রাইপুরের মটগোদায় তৃণমূলের দলীয় অফিসের সামনে এখানেই চলে গুলি।

ফোনে জানিয়েছিলেন, তিনি বাড়ি ফিরছেন। খাবার সাজিয়ে রাখতে বলেছিলেন স্ত্রীকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফের বেজে উঠেছিল সুলেখাদেবীর ফোন। খবর আসে, তাঁর স্বামী তৃণমূলের রাইপুর ব্লক কার্যকরী সভাপতি অনিল মাহাতো (৪৫) গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এক লহমায় পায়ের তলার মাটিটা যেন দুলে উঠেছিল। আরও কিছুক্ষণ পরে খবর পেয়েছিলেন— সব শেষ। অনিলবাবু আর কোনও দিনই বাড়ি ফিরবেন না।

শনিবার ধানঘরির বাড়িতে বছর নয়েকের ছেলে শুভম এবং দুই মেয়ে অদিতি ও অনন্যাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শুক্রবার রাতের ঘটনার কথা বলছিলেন সুলেখাদেবী। বড় মেয়ে অদিতি স্নাতক স্তরের ছাত্রী। মোবাইল ফোনে কললিস্ট বের করে তিনি বলেন, “এই শেষ। রাত ৯টা ৫। বাবার শেষ ফোন। এখনও যেন মনে হচ্ছে, ফোন করলেই আবার গলাটা শুনতে পাব।’’ কান্নায় ভেঙে পড়েন অদিতি।


শুক্রবার সকালেও পড়েছিল রক্ত। নিহত নেতা অনিল মাহাতোর ধানঘরির বাড়িতে স্ত্রী ও সন্তানরা।

অনিলবাবুর খুনের ঘটনায় জঙ্গলমহলের ফেলে আসা সেই অশান্ত দিনগুলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে অনেকেরই। এ দিন সকাল থেকে দোষীদের গ্রেফতারির দাবিতে বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়কের বিভিন্ন এলাকায় পথ অবরোধ করেন অনিলবাবুর অনুগামীরা। এলাকাও ছিল থমথমে। প্রায় কোনও দোকানই খোলেনি। বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, বছর ছয়-সাতেক আগে এই ছবিটা দেখা যেত রাইপুর-সহ জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায়। তখন মাওবাদীদের আতঙ্কে থমথম করত এলাকা। রাজ্যে পালাবদলের পর মাওবাদীদের চিহ্ন প্রায় মুছে গিয়েছে জঙ্গলমহল থেকে। কিন্তু হানাহানির ছবিটা বদলাচ্ছে না।

সুলেখাদেবী এ দিন বলেন, ‘‘দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিলই। মারপিট, ঝামেলা, ফোনে হুমকি লেগেই থাকত। তবে এমনটা যে হয়ে যাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।’’ তিনি মৌখিক ভাবে এ দিনও বলেন, ‘‘দলের ব্লক সভাপতি জগবন্ধু মাহাতো আমার স্বামীকে মোটেই পছন্দ করতেন না। স্বামীকে তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকেরাই খুন করেছেন।’’ অনিলবাবুর অনুগামীদের একটা বড় অংশ ঘটনার পরে সরাসরি দায়ী করছেন দলের অন্দরে তাঁর বিরোধী গোষ্ঠীর লোকেদের। নিহত নেতার ঘনিষ্ঠ দলের রাইপুর ব্লক যুব সভাপতি রাজকুমার সিংহেরও অভিযোগ, ‘‘অনিলদাকে যাতে ব্লক সভাপতি না করা যায়, সে জন্য দলের অনেকেই তাঁর পিছনে লেগেছিল। তাঁদের পক্ষে এই খুন করা অস্বাভাবিক নয়।’’

এ দিন তাঁদের রোষের চেহারা দেখে নিজেকে কার্যত গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন জগবন্ধুবাবু। ব্লক সভাপতি হয়েও কেন দলের কার্যকরী সভাপতির শেষযাত্রায় তাঁকে দেখা গেল না? তাঁর জবাব, “আমি বাইরে গেলে ঝামেলা বাড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন। তাই ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারিনি।” তবে অনিলবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব বিরোধের কোনও যোগ নেই বলেই দাবি করেছেন তিনি।

এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন মধ্যচল্লিশের অনিলবাবু। এ দিন সকালে রাইপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যখন তাঁর দেহ বের করে আনা হচ্ছে, হাসপাতালের বাইরে তখন প্রায় হাজার খানেক মানুষের ভিড়। বাঁকুড়া জেলার এক প্রান্তে থাকা রাইপুর ব্লককে অনিলবাবু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজকুমারবাবু নতুন জেলা হতে চলা ঝাড়গ্রামে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন। ঝাড়গ্রামে মুখ্যমন্ত্রী কয়েক মাস আগে এলে তাঁরা সেখানে দাবি জানিয়ে আসেন। তা নিয়েও ব্লক নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ সামনে আসে। তাঁর মৃত্যুতে ওই দাবি অবহেলিত হবে বলে এলাকার অনেকেই আশঙ্কা করছেন।

খুনের প্রতিবাদে রাইপুরের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল কর্মীরা দিনভর অবরোধ চালান। যানবাহন আটকে পড়ে।

তবে এই খুনের পিছনে কারা রয়েছেন তা নিয়েই নানা জল্পনা শোনা গিয়েছে এ দিন। এই ঘটনার পিছনে বড়সড় ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি করছেন অনেকে। ঘটনা হল, গত সাতদিন ধরে কিছু মানুষ রাইপুর ব্লকের মটগোদা ও সংলগ্ন এলাকায় সাপের উৎপাতের খবর রটিয়ে বেরাচ্ছিল। সে জন্য মটগোদা ও সংলগ্ন এলাকার মানুষজন রাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। দোকানপাটও সাত তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এলাকা দ্রুত সুনসান হয়ে যাচ্ছিল। রাজকুমারবাবু এ দিন হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, “এখন মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা এই ঘটনা ঘটাবে বলে আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিল। সে কারণেই এলাকা ফাঁকা করতে ওই সব অলৌকিক কিছু ঘটনার গুজব ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে ভয় ছড়িয়েছিল। তা না হলে রাত ৯টায় মটগোদার বাজার বেশ জমটিই থাকে। কিন্তু ওই গুজবের কারণে ইদানীং রাতে দ্রুত বাজার খালি হয়ে যাচ্ছিল।’’

অনিলবাবুর পাড়াতুতো ভাইপো সমীর মাহাতো জানান, ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে সন্ধ্যায় শেষবারের মতো অনিলবাবুর সঙ্গে তাঁর কথা হয়। অনিলবাবু তাঁকে বিশেষ কিছু কাজের জন্য ফুলকুসমা যেতে বলেছিলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি অনিলবাবুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শোনেন। বাঁকুড়ায় ময়নাতদন্তের পরে এ দিন বিকেলে অনিলবাবুর দেহ নিয়ে আসা হয় রাইপুরে। উপস্থিত ছিলেন জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। অনিলবাবুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।

এ দিন তৃণমূল কর্মীদের পথে নেমে প্রতিবাদ চলার মধ্যেই খবর আসে সিপিএমের মটগোদা লোকাল কমিটির অফিসে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। শূন্যে গুলি চালানোরও অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তৃণমূল নেতৃত্ব এ সব অস্বীকার করলেও সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তথা প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি পার্থপ্রতিম মজুমদার বলেন, ‘‘আমরা চাই দোষীরা ধরা পড়ুক। কিন্তু যে ভাবে আমাদের দলীয় কার্যালয়ে আগুন লাগানো হলো এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

ছবিগুলি তুলেছেন অভিজিৎ সিংহ।

leader politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy