সুপ্রিম কোর্ট নিষাধাজ্ঞা জারি করেছে। তার পরেও সড়কের ধারে থাকা মদের দোকান বাঁচাতে এক দিকে রাজ্য সড়কের তকমা ঘোচানোর দাওয়াই দিচ্ছে রাজ্য সরকার। কারণ, হঠাৎ করে একলপ্তে এত দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকেই। আবার সুযোগের ‘সদ্ব্যবহার’ করছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরাও। এক দিকে, রাস্তার ধারে থাকা গুমটিগুলিতে মদ মিলতে শুরু করেছে। অন্য দিকে, চোলাইয়ের ঠেক ও বিক্রির বৃদ্ধির আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। গোটা পরিস্থিতির জন্য সময় থাকতে প্রশাসনের ব্যবস্থা না নেওয়াকেই দায়ী করছে বিভিন্ন মহল।
এ দেশে পথ দুর্ঘটনায় প্রায় ২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে শুধু ২০১৬ সালেই। পথ দুর্ঘটনা সংক্রান্ত একটি মামলার সূত্রে মদ্যপ চালকদের রুখতে জাতীয় সড়কের ধারে মদের বিক্রি নিষেধ করা নিয়ে ২০১৫ সালেই নিজের দৃঢ় অবস্থান স্পষ্ট করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। এর পরে গত ১৪ ডিসেম্বর ১ এপ্রিল থেকে জাতীয় ও রাজ্য সড়কের ৫০০ মিটারের মধ্যে মদের অফশপ ও অনশপ বিক্রিবাটা নিষিদ্ধ করে সুপ্রিম কোর্ট। গত মার্চে একটি রিভিউ পিটিশনে রাস্তার ধারে থাকা বার, হোটেল, রেস্তোরাঁ থেকে ওই নিষেধ তুলে নেওয়ার আবেদনকেও খারিজ করে দেয় কোর্ট। তবে, রাস্তা থেকে দূরত্বের ক্ষেত্রে শর্ত খানিকটা শিথিল করা হয়। ২০ হাজারের কম লোকালয় বিশিষ্ট এলাকার ক্ষেত্রে সড়কের ধারে থাকা মদের দোকানের দূরত্ব ৫০০ থেকে কমিয়ে ২২০ মিটার করা হয়েছে।
দুবরাজপুর পুর এলাকায় থাকা সাতকেন্দুরী মোড়ে রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের সঙ্গে মিশছে ১৪ নম্বর রাজ্য সড়ক। রোজ হাজার হাজার যানবাহন যাতায়াত করে ওই মোড় দিয়ে। বড় অংশই ক্ষণিকের বিরতি নেয় সাতকেন্দুরীতে। খান বিশেক লাইন হোটেল, ধাবা রয়েছে। আহারের সঙ্গে পানীয়ের সুবন্দোবস্ত। এত দিন তাই-ই ছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গত শনিবার থেকে অবশ্য তা সরকারি ভাবে বন্ধ। এলাকাবাসীর একাংশের যদিও দাবি, ‘‘এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে মদ কেনা বেচা হচ্ছে না। হোটেল, ধাবায় লুকিয়ে চুরিয়ে মদ বিক্রি চলছেই। আর এই পরিস্থিতিতে বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে রাস্তার ধারে থাকা পানগুমটি বা চায়ের দোকানগুলিতে।’’
এমন ছবি শুধু সাতকেন্দুরীতেই নয়, কমবেশি গোটা জেলারই বলে অভিযোগ। খয়রাশোলের ভীমগড় থেকে নলহাটি, বোলপুর থেকে ইলামবাজার, ইলামবাজার থেকে দুবরাজপুর— কোথাও রাস্তার ধারে প্রকাশ্যে মদ বিক্রি না হলেও চোরাগোপ্তা সবই চলছে বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদেরই। কেন? ইলামবাজার ও দুবরাজপুরের দুই লাইন হোটেল মালিক বলছেন, ‘‘এ ভাবে রাতারাতি সব বন্ধ করা যায় নাকি? মদ বিক্রি না করলে হোটেল-ধাবা দু’দিনেই উঠে যাবে।’’ তাঁদের বক্তব্য সমর্থন করে অনেকে আবার এই ব্যবসায় বহু লোকের কাজ হারানোর প্রসঙ্গও তুলছেন।
এরই মাঝে আরও একটি দিক থেকে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন জেলার পুলিশ ও আবগারি দফতরের আধিকারিকেরা। এক পুলিশ কর্তার আশঙ্কা, ‘‘হিতে বিপরীত না হয়! এ বার তো মদের পাচার বাড়বে। বাড়বে বিষমদে অসুস্থের সংখ্যাও।’’ এক আবগারি আধিকারিকের আবার বক্তব্য, ‘‘জেলার এমন বেশ কিছু অঞ্চল তৈরি হল, যেখানে একটিও মদের দোকান রইল না। মদ্যপরা তো বেআইনি দোকানের দিকেই ঝুঁকবেন। পাড়ায় পাড়ায় ছোটখাট দোকানে মদ বিক্রি হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।’’ চোলাইয়ের উপদ্রবও বাড়বে বলে তাঁর আশঙ্কা।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে যাঁরা আশায় আলো দেখছেন, পথ দুর্ঘটনায় প্রিয়জনদের হারানো সেই পরিজনদের অনেকেরই অবশ্য বক্তব্য, ‘‘আদালত তো দুম করে এক দিনে দোকানে ঝাঁপ ফেলার নির্দেশ দেয়নি। পরিস্থিতি সামলানোর জন্য যথেষ্ট সময় দিয়েছিল। তার পরেও প্রশাসন নড়েচড়ে না বসাতেই বহু মানুষকে কাজ হারাতে হল।’’ তাঁদের অভিযোগ, নানা রকম আশঙ্কার কথা জনমানসে তুলে ধরে প্রথম থেকেই বেআইনি মদ রোখার ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করা শুরু করেছেন এক শ্রেণির পুলিশ ও আবগারি আধিকারিক। জেলা আবগারি সুপার তপনকুমার রায় অবশ্য বলছেন, ‘‘বেআইনি মদ রুখতে আমরা বছরভর অভিযান চালাই।’’ আশার কথাও শুনিয়েছে পুলিশও। ‘ব্রিদ অ্যানালাইজারে’র পরীক্ষায় গত ক’দিনে মদ্যপ চালকদের সংখ্যা তুলনায় অনেক কম পেয়েছে দুবরাজপুর পুলিশ।