গত বিধানসভা ভোটের সময়েও রঘুনাথপুরে প্রচারের অন্যতম বিষয় ছিল শিল্প। এ বারে শিল্প নিয়ে কথাবার্তার অধিকাংশটাই নেতারা বলছেন রঘুনাথপুর ১ ব্লক এলাকায় গিয়ে। অন্যত্র সেই সংক্রান্ত কথাবার্তা কারও মুখেই তেমন শোনা যাচ্ছে না। বরং পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে রঘুনাথপুরের গণ্ডগোলের প্রসঙ্গ লোকসভা ভোটের প্রচারের ময়দানেও টেনে আনছে বিরোধী বিভিন্ন দল। অভিযোগ তুলছে, এই এলাকায় অবাধ ভোট হয়নি ‘সন্ত্রাস’-এর জন্য। নিশানা করছে শাসকদলকে। তবে তৃণমূল সন্ত্রাসের অভিযোগ গোড়া থেকেই উড়িয়ে দিয়ে আসছে। রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউড়ি দাবি করছেন, ‘‘লোকসভা নির্বাচনের ব্যাপারটা পুরোপুরি আলাদা। মানুষ দেখেছেন, গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবে সবার সর্বনাশ করেছে। সেটাই ভোটের ফল নির্ধারণ করবে।’’
রাজ্যের যে সমস্ত এলাকায় বাম আমলে শিল্পায়নের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল, বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর ছিল তার অন্যতম। এখানে হয়েছে ডিভিসির তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। দু’টি বড় ইস্পাত এবং সিমেন্ট কারখানার শিলান্যাস করেছিলেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপিএম প্রচারে বলছে, পালাবদলের পরে বেসরকারি শিল্প সংস্থা দু’টির ইস্পাত কারখানা গড়ার কাজ থমকে গিয়েছে। হয়েছে শুধু ডিভিসির তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাম প্রার্থী অমিয় পাত্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রচারে বেরিয়ে বাঁকুড়ার প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া দাবি করছেন, বাম আমলেই রঘুনাথপুর ১ ব্লকের নতুনডিতে প্রায় ২ হাজার একর জমি শিল্পের জন্য অধিগ্রহণ হয়েছিল। হাতে মোয়া পাওয়ার মতো তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতায় এসে সেই ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ পেয়েছে। বাসুদেববাবু বলেন, ‘‘কোনও কাজই তার পরে হয়নি। বাম আমলে অধিগ্রহণ করা জমি দেখিয়ে নিজেদের ঢাক পেটাচ্ছে এখনকার শাসকদল।’’ তৃণমূল আবার অভিযোগ করছে, অক্ষম সংস্থাকে জমি দিয়ে শিল্পের নাম করে জমি অধিগ্রণ করেছিল বাম সরকার। তাতে আখেরে চাষিদের সর্বনাশই হয়েছে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গত পঞ্চায়েত ভোটে রঘুনাথপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অশান্তির খবর এসেছে। বোমা পড়েছে। গুলি ছুটেছে। বিজেপির প্রার্থী সুভাষ সরকার এই এলাকায় প্রচারের শুরুটাই করেছিলেন রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির অফিসের সামনে সাদা পায়রা উড়িয়ে। বোর্ড গঠনের দিনে যেখানে বোমাবাজি করে বিজেপির জেতা সদস্যদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। সুভাষবাবু বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েতে তৃণমূলের লাগামহীন সন্ত্রাসকে আমরা প্রচারে তুলে ধরছি।’’
রঘুনাথপুর বিধানসভার তিনটি পঞ্চায়েত সমিতি। গত পঞ্চায়েত ভোটে দু’টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জেতে বিজেপি। পরে বিজেপির নির্বাচিত সদস্যেরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় সব ক’টি সমিতিই শাসকদলের হাতে এসেছে।
বিজেপির অভিযোগ, তাঁদের সদস্যদের ‘ভয় আর প্রলোভন’ দেখিয়ে নিজেদের দিকে টেনেছে তৃণমূল। তারা দাবি করছে, জনমত ‘পরিবর্তন’-এর আঁচ পাওয়া গিয়েছে পঞ্চায়েতেই। তাই এ বার বিজেপি প্রচারে নেমে জোর দিচ্ছে বাড়ি বাড়ি ঘুরে জনসংযোগেই।
সিপিএমের এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি ছিল রঘুনাথপুর। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল রঘুনাথপুর দখল করে। সেই ইস্তক তৃণমূলের লিড উত্তোরত্তর বাড়ছিলই। তালটা কেটেছে গত পঞ্চায়েতে। সিমিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বাসুদেববাবু মানছেন, বামেদের নীচুতলার ভোট ব্যাঙ্কের একটা অংশ পঞ্চায়েতে বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিল। লোকসভা ভোটে বামেরা জোর দিচ্ছে নীচুতলার সেই কর্মীসমর্থকদের আবার দলের কাজে যুক্ত করতে। ওই কর্মীসমর্থকেরা ‘ঘরে ফিরছেন’ বলে দাবি বাসুদেববাবুর।
তৃণমূলের জন্য এ বারের ভোটে অন্যতম লক্ষ্য দলের ভিতরের কোন্দল লড়াইয়ের ময়দানে ঢুকতে না দেওয়া। বিধানসভা এলাকায় চরকিপাক ঘুরে দলের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউড়ি বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
তাঁর দাবি, সবাই এক হয়ে ভোটের কাজে শামিল হয়েছেন। পূর্ণচন্দ্রবাবু বলেন, ‘‘মানুষ গত পাঁচ বছরে দেখেছে কেন্দ্র সরকারের নোটবাতিল, জিএসটি-র জন্য কী ভাবে সবার সর্বনাশ হয়েছে।” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বাসুদেববাবুও বলছেন, ‘‘কেন্দ্র সরকারে ভ্রান্ত জনবিরোধী নীতির ফলে দেশজুড়ে কৃষকদের শোচনীয় অবস্থা হয়েছে। রঘুনাথপুর-সহ গোটা রাজ্যেই গত আট বছরে একটিও শিল্প না হওয়াতে কর্মসংস্থান হয়নি। মানুষ সবটাই দেখেছে।” আর বিজেপির সুভাষবাবুর বক্তব্য, ‘‘রঘুনাথপুরে সম্ভবনা থাকলেও শিল্প না হওয়ার জন্য বাম ও তৃণমূল দু’তরফই সমান ভাবে দায়ী।”
চলছে দড়ি টানাটানি। ভোটে চলেছে রঘুনাথপুর।