সকাল সাড়ে আটটা। রঘুনাথপুর শহরের হাটতলার সব্জি বাজার তখন বেচাকেনায় সরগরম। হঠাৎই পরপর বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠল গোটা এলাকা! প্রথম দিকে লোকজন হকচকিয়ে গেলেও পরে বোঝেন, বাজারের কাছে ছোট একতলা ঘর সেই শব্দের উৎস। কারণ, সেই ঘর তখন দাউদাউ জ্বলছে।
ভরা বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। বেচাকেনা ছেড়ে ছুট লাগিয়েছিলেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পরপর বিস্ফোরণ হয় বলে এলাকাবাসীর দাবি। তবে, খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে দমকলের একটি ইঞ্জিন আগুন নেভায়। তার পরে আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ওই ঘরে মজুত করে রাখা অবৈধ শব্দবাজি ও আতসবাজি ফেটেছে। ঘটনাস্থল থেকে দু’টি বস্তা উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাতে শব্দ ও আতসবাজি পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করেছেন পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার। যদিও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ এমনকী, এলাকার তৃণমূল কাউন্সিলর মদন বরাটেরও দাবি, এ দিন বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে ওই বাড়িতে। বাড়িটির মালিক অমিতাভ গোস্বামীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় যে আরও এক জনের নাম জড়িয়েছে, অমিতাভবাবুর সেই ছোট জামাই অবশ্য এখনও অধরা।
থানা থেকে মাত্র তিনশো মিটারের দূরত্বে চার নম্বর ওয়ার্ডের হাটতলার সব্জিবাজারের মত জনবহুল এলাকার ওই বিস্ফোরণে অনেক কিছুই ঘটতে পারত বলে আশঙ্কা স্থানীয় মানুষের। পুরপ্রধান ভবেশ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ভাগ্যক্রমে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটেনি।’’ এ দিন দ্রুত ঘটনাস্থলে যান রঘুনাথপুরের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে তদন্তে আসেন পুলিশ সুপার। তদন্তের শেষে বাড়িটিকে সিল করে দিয়েছে পুলিশ।
গত বছর ২০ মার্চ রঘুনাথপুরের ব্লকডাঙ্গা এলাকায় হদিস মিলেছিল অস্ত্র তৈরির কারখানার। পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার নিজে অভিযান চালিয়ে এক ভাড়া বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিলেন আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের প্রচুর খোল। আর এ দিন হাটতলা সব্জিবাজার এলাকায় পরপর বিস্ফোরণে শহরে আরও আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। শহরে বিস্ফোরণের খবর চাউর হতেই সব্জিবাজার এলাকায় ওই বাড়ির চারপাশে ভিড় জমান প্রচুর লোকজন। দিনভর শহরের আনাচেকানাচে এই বিস্ফোরণ-কাণ্ড নিয়েই আলোচনা হয়েছে।
হাটতলার রাস্তার পাশেই ছোট্ট দোতলা বাড়ি অমিতাভ গোস্বামীর। বাড়ির একপাশে দু’টি ছোট অ্যাসবেস্টসের ঘর। পুলিশ জানায়, তারই একটিতে মজুত করে রাখা হয়েছিল নিষিদ্ধ শব্দবাজি। বিস্ফোরণের চোটে উড়ে গেছে ওই বাড়ির চাল। পাশের বাড়ির অ্যাসবেস্টসের ছাদও ফেটেছে। পুড়ে গিয়েছে পাশের বাড়ির জলের ট্যাঙ্ক। পুলিশের দাবি, কোনও ভাবে আগুন লেগে এতক্ষণ ধরে ফেটেছে শব্দবাজি। এক সঙ্গে অনেক বাজি ফাটায় বোমা বিস্ফোরণের মতো আওয়াজ হয়েছে। বড়মাপের শব্দবাজি ও আতসবাজি ফাটায় ঘরটির চাল উড়ে গিয়েছে।
তবে, পুলিশ যাই দাবি করুক না কেন, এ দিন সকালে যে ভাবে আধঘণ্টা ধরে পরপর বিস্ফোরণ হয়েছে ওই বাড়িতে, তাতে স্রেফ শব্দবাজি ফেটেছে বলে মানতে নারাজ এলাকার বাসিন্দারা। অমিতাভবাবুর পাশেই বাড়ি শুক্লা মুখোপাধ্যায়, দিলীপ ধীবর, বিপ্লববিজয় ঘোষের। তাঁরা জানান, বোমাই ফেটেছিল। রীতিমতো কেঁপে উঠেছিল পুরো এলাকা। অনেক দূর থেকেও বহু লোক বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনেছেন। কিছু বাসিন্দার আবার দাবি, বোমা ফাটলে যেমন লোহার টুকরো বা স্প্লিন্টার ছড়িয়ে পড়ে, এ দিন বিস্ফোরণের পরে তেমনই ধাতব টুকরো ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। সব মিলিয়ে ওই বাড়িতে বাজির আড়ালে বোমা তৈরি হত কিনা, সে সন্দেহও প্রকাশ করেছেন অনেকে।
দিলীপবাবুর কথায়, ‘‘ওই ব্যক্তি যে শব্দবাজির কারবার করেন, তা এলাকার অনেকেই জানতেন। কিন্তু, তা বলে পাড়ার মধ্যেই এত পরিমাণ শব্দবাজি বা বারুদ মজুত করে রেখে দিয়েছেন, তা জানার কোনও উপায় ছিল না। এ দিনের বিস্ফোরণের পরে সব বোঝা গেল!’’ আরও বড় ধরনের ঘটনা যে ঘটেনি, সেটা ভেবেই এখন স্বস্তিতে এলাকাবাসী। অমিতাভবাবু কারও সঙ্গে বিশেষ মেলামেশা করতেন না বলেও প্রতিবেশীরা জানান। পাশাপাশি, পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন শহরের বাসিন্দাদের বড় অংশ। তাঁদের বক্তব্য, থানার এত কাছে এত দিন এই কারবার চলছে। অথচ পুলিশ তা জানতেই পারল না! এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
অমিতাভবাবুর বাড়ির একটি ঘর নিয়ে ভাড়া থাকেন হুগলির এক বাসিন্দা। এ দিন বিস্ফোরণের পরেই ওই ঘটনায় তাঁর যোগ রয়েছে সন্দেহ করে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেন স্থানীয় কিছু বাসিন্দা। পুলিশ অবশ্য ওই ব্যক্তিকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের পরে জানিয়েছে, তিনি পনেরো বছর ধরে রঘুনাথপুরে ওই বাড়িতে ভাড়ায় আছেন। সোনার গয়না পালিশের কাজ করেন। শহরের অনেক সোনার দোকানি তাঁর কাছে কাজ করান। বাসনপত্র, প্লাস্টিকের সামগ্রী, জামাকাপড়-সহ হরেক জিনিসের ব্যবসায়ী অমিতাভবাবু দোতলায় থাকেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে। নীচে একতলার একটি ঘরে তাঁর দোকান। পাশেই ছোট দু’টি ঘরের একটিতে ভাড়ায় থাকেন হুগলির ওই বাসিন্দা। অন্য ঘরটিতে শব্দবাজি মজুত করে রাখা হয়েছিল। অমিতাভবাবু পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, তিনি নন, তাঁর ছোট জামাই নিশীথ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ঘরে শব্দবাজি মজুত করে রেখেছিলেন। নিশীথ বিয়েতে অর্ডার অনুযায়ী ওই বাজি সরবরাহ করেন। সামনেই একটি বিয়ে থাকায় বেশি পরিমাণে বাজি মজুত করেছিলেন।
এ দিন পুলিশ সুপার রঘুনাথপুর আসার পরে অমিতাভবাবুকে দীর্ঘ জেরা করেন। পরে তাঁকে নিয়েই পুরুলিয়ায় ছোট জামাইয়ের সন্ধানে যায় পুলিশ। পুরুলিয়া শহরের স্টেশনপাড়ায় ভাড়াবাড়িতে নিশীথ এখন থাকেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। কিন্তু সেখানে হানা দিয়েও তাঁকে না পেয়ে এক নম্বর ওয়ার্ডের গিরীশপল্লিতে, নিশীথের মামাবাড়িতে যায় পুলিশ। সেখানেও তাঁর সন্ধান মেলেনি। নিশীথের দিদিমা মণিকা চট্টরাজ জানান, চার বছর আগে বিয়ের পর থেকে এই বাড়িতে নিশীথ থাকেন না। তবে ভোট দিতে গত মাসে এসেছিলেন। নিষিদ্ধ শব্দবাজির ব্যবসা তাঁর নাতি করে কিনা, সে বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি তিনি।