Advertisement
E-Paper

পর্যটনের স্বপ্ন দেখছে নন্দীকেশ্বরী তলা

একটি গঞ্জ আর সেই গঞ্জ গড়ে ওঠা নিয়ে নানা গল্প। তাকে ঘিরেই দানা বাঁধছে, পর্যটনের স্বপ্ন। সাঁইথিয়া। নন্দীপুর কি ভাবে সাঁইথিয়া হল সে নিয়ে শেষ নেই সে গল্পের। শহরের বাসিন্দা তাপস দত্ত, ইন্দুপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, উমাপদ রুজ, প্রভাত বন্দ্যোপাধ্যায়দের কাছে সাঁইথিয়া মানেই নীলকর সাহেবদের ইতিহাস। তাঁরা জানান, ময়ূরেশ্বরের রামনগরে ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তর পাড়ে সাহেবদের নীলকুঠি ছিল।

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০২:২৮
সংস্কারের পরে হাল ফিরেছে মন্দির চত্বরের। —নিজস্ব চিত্র

সংস্কারের পরে হাল ফিরেছে মন্দির চত্বরের। —নিজস্ব চিত্র

একটি গঞ্জ আর সেই গঞ্জ গড়ে ওঠা নিয়ে নানা গল্প। তাকে ঘিরেই দানা বাঁধছে, পর্যটনের স্বপ্ন।
সাঁইথিয়া। নন্দীপুর কি ভাবে সাঁইথিয়া হল সে নিয়ে শেষ নেই সে গল্পের। শহরের বাসিন্দা তাপস দত্ত, ইন্দুপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, উমাপদ রুজ, প্রভাত বন্দ্যোপাধ্যায়দের কাছে সাঁইথিয়া মানেই নীলকর সাহেবদের ইতিহাস। তাঁরা জানান, ময়ূরেশ্বরের রামনগরে ময়ূরাক্ষী নদীর উত্তর পাড়ে সাহেবদের নীলকুঠি ছিল। নীলকুঠির সাহেবরা নদীর দক্ষিণ পাড়ের নানা কাজে সিউড়ি বা অন্যান্য স্থানে যাতায়াতের সময় জলপথে ও ঘোড়ায় চড়ে প্রথমে নন্দিকেশ্বরী মন্দিরে এসে থামতেন। সেখানে বিশ্রাম নিতেন। আর সেখানে বসেই এলাকার কর আদায়-সহ নানা কাজ করতেন। নন্দীপুর যুক্তাক্ষর হওয়ায় সাহেবরা ঠিকানা বলতে গিয়ে বলতেন, ‘সাঁইথা’। সেই থেকে কালক্রমে সাঁইথিয়া। সংস্কারের জোয়ারে চালচিত্র বদলে গেলেও এলাকার মানুষ স্বপ্ন দেখছে পর্যটনের।
কেউ কেউ এমনও বলেন, ‘সাইত’ শব্দ থেকে ‘সাঁইথিয়া’। মন্দিরের প্রবীণ সেবাইত ইন্দুভূষন চক্রবর্তী, কৃষ্ণকুমার চট্টোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘নন্দিকেশ্বরী মন্দির চত্বরে বেলগাছ ও এক সাধু থাকার কথা জানি। কিন্তু ‘সাইত’ শব্দ থেকেই ক্রমে সাঁইথিয়া নামকরণ হয়েছে। স্থানীয় জমিদাররা তাঁদের জমিদারির পত্তন করার সময় ওই স্থানে ‘সাইত’-এর অনুষ্ঠান করতেন। এবং ‘সাইত’ মাধ্যমে মহালের সূচনা করতেন। তখন থেকেই নাম হয় ‘সাইতা’। লোকমুখে সেই ‘সাইতা’ হয়ে ওঠে সাঁইথিয়া।’’
কথিত আছে, সতীর কন্ঠের হাড় পড়েছিল এই নন্দিকেশ্বরী তলায়। সেখানেই মন্দির গড়ে ওঠে। সেবাইতরাই মন্দির পরিচালনা করতেন। ১৯৮০-র দশকে শহরের বিশিষ্ট প্রয়াত শিল্পপতি নারায়ণ প্রসাদ চন্দ্র, গৌরী প্রসন্ন দত্ত এবং ব্যবসায়ী প্রয়াত মহেন্দ্র গুঁই-সহ কিছু বিশিষ্ট মানুষের উদ্যোগে সতিপীঠ নন্দিকেশ্বরী মন্দির সংস্কার কমিটি গঠন হয়। ওই কমিটিই মন্দির সংস্কারের সূচনা করে। পরে, মূল মন্দির ও জগন্নাথ দেবের মন্দির নির্মাণে প্রয়াত নির্মল চন্দ, প্রয়াত নীহার দত্ত, প্রয়াত শৈলেন চন্দ্র দাস, প্রয়াত বিমল সরকার, নিমাই দত্ত, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়-সহ শহরের বহু বিশিষ্ট জনেরা মন্দিরের দেখভাল ও উন্নয়নের স্বার্থে একটি ট্রাস্ট কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটির উদ্যোগে মন্দিরের পাঁচ-ছ ফুট উচ্চতার ভগ্নপ্রায় দেওয়াল ভেঙে ফেলা হয়। মূল মন্দিরের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেবদেবী ও রাধাগোবিন্দের নাট মন্দিরটিকেও নন্দিকেশ্বরীর মূল মন্দিরের ঘেরা দেওয়ালের সঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এবং মন্দিরের জায়গায় গড়ে তোলা হয় ধর্মশালা ও যাত্রী নিবাস।

মূল মন্দির-সহ চত্বরের সমস্ত মন্দিরকে নতুন কলেবরে সাজানো হয়। মন্দিরের প্রবেশ পথের ডান দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় জগন্নাথ দেবের মন্দির। এসব করার সময় একটি বড় অশ্বত্থ গাছ-সহ কয়েকটি গাছ কেটে ফেলা হয়। তবে মন্দিরের মূল আকর্ষণ বিশাল বট বৃক্ষটি আজও অক্ষত রয়েছে। কিন্তু এসব করার ফলে বহু দীন দুখি মানুষ, বাউল ফকিররা রোদ বৃষ্টি ঝড় জলে তাঁদের আস্তানা হারিয়েছেন। ৮৫ বছরের ইন্দুভূষন চক্রবর্তী, কৃষ্ণকুমার ভট্টাচার্য ও তাঁদের চেয়ে বয়সে ছোট রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়— এই তিনটি পরিবারের পূর্ব পুরুষরা প্রাচীনকাল থেকেই এই মন্দিরের সেবাইত।

এই তিন সেবাইতের কথায়, মূল মন্দিরের বাইরে রাধা গোবিন্দ মন্দিরের সামনের আটচালায় জাত ধর্ম নির্বিশেষে অসহায় মানুষেরা তাঁদের ইচ্ছামতো রান্না- খাওয়া ও রাত্রিবাস করতেন। দূর দূরান্তের বহু বাউল ফকিরদেরও সুবিধা অসুবিধার রাত্রি বাসের ঠিকানা ছিল এই আটচালা। আধুনিকতা ও সৌন্দার্যায়নের কারণে ওই সব মানুষের ঠিকানা আজ অতীত। আজকের মতো এত জাঁকজমক না থাকলেও দেশ বিদেশের বহু মানুষ ও ভক্ত এখানে আসতেন। অবশ্য সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সেই সংখ্যা বেড়েছে। শহরের মাঝ বয়সি উজ্জ্বল ঘোষ, শ্যামল মিত্র, দূর্গা দাস, ফটিক মণ্ডলরা বলেন, ‘‘মন্দির ও মন্দির চত্বরের চাক-চিক্য বেড়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে ঠিকই। কিন্তু কোথাও যেন একটা ঘাটতি রয়ে গেছে। মন্দিরে বা ওই নাট মন্দিরে আগে যে শান্তি বিরাজ করত, এখন তা ইঁট পাথরের কংক্রিটে যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছে। নজর দিলে পর্যটনের বিকাশ সম্ভব এখানেই।’’ এমন দাবির পাশাপাশি মন্দির এলাকার উন্নয়নের চালচিত্রটিও দেখে নেওয়া যাক।

পুরসভা ও পর্যটন দফতরের পক্ষ থেকেও মন্দির ও মন্দির চত্বরকে নানা ভাবে সাজানো হয়েছে। আরও আধুনিক করার প্রক্রিয়া চলছে। মন্দিরের মূল প্রবেশ পথের সম্মুখে বিশাল আলোর স্তম্ভ বসানো হয়েছে। ওই স্তম্ভের নীচে জলের ফোয়ারা ও চারটি বড় বড় ঘোড়ার স্ট্যাচু বসানো হয়েছে। মন্দিরের সামনের ফাঁকা জায়গা ও রাস্তাটি রেলের। ওই রাস্তার আশেপাশের জায়গায় বেশ কিছু দোকানপত্র গজিয়ে উঠেছে। তবু যেটুকু ফাঁকা আছে সেটুকুতেই, রথের সময় মেলা বসে।

নতুন সাজে হয়তো সেজে উঠেছে নন্দিকেশ্বরী মন্দির-তলা, কিন্তু আধুনিকতার ছোঁওয়ায় হারিয়ে গিয়েছে নানা স্মৃতি-ছাপ। এমনই বলতে চান এলাকার মানুষ। পুরপ্রধান বিপ্লব দত্ত বলেন, ‘‘নানা জটিলতা ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনে সাঁইথিয়ার তেমন উন্নতি ঘটেনি। গল্পে গাঁথা এই শহর সে ভাবে পর্যটন কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি। অথচ সাঁইথিয়া থেকে জেলা বা জেলার বাইরে এমনকী মুর্শিদাবাদ ও অন্য জেলায় যাতায়াতের ক্ষেত্রেও এই শহরের বিকল্প কম আছে। শুধু তাই নয়, নন্দিকেশ্বরী মন্দিরের ধর্মশালায় থাকার খরচও অনেক কম। পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, ভাবনা-চিন্তা চলছে।’’

tourist spot bhaskarjyoti majumdar sainthia municipality
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy