Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

গ্রামের পাশে নদী, বাড়ি মিলল নিকিতার

অনেক সাধাসাধির পরে এক রত্তি মেয়েটা বলেছিল, তার নাম দুর্গা। বাড়ি? বড় বড় দু’চোখ উত্তরহীন। এক বছর ধরে অনেক বোঝানোর পরে সে জানিয়েছিল, জায়গাটার নাম ‘মান্ডিদীপ’। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে নদী। ২০১২ সালে বর্ধমানের কালনার সিঙ্গেরকোণ এলাকা থেকে উদ্ধারের পরে বাঁকুড়ার ছাতনার হোমে আসা বছর চারেকের মেয়েটিকে দেড় বছর ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে এইটুকু তথ্যই মেলে। সেই সূত্র ধরেই মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলায় মান্ডিদীপের হদিস মিলেছে।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০২:২৯
Share: Save:

অনেক সাধাসাধির পরে এক রত্তি মেয়েটা বলেছিল, তার নাম দুর্গা।

বাড়ি? বড় বড় দু’চোখ উত্তরহীন।

এক বছর ধরে অনেক বোঝানোর পরে সে জানিয়েছিল, জায়গাটার নাম ‘মান্ডিদীপ’। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে নদী। ২০১২ সালে বর্ধমানের কালনার সিঙ্গেরকোণ এলাকা থেকে উদ্ধারের পরে বাঁকুড়ার ছাতনার হোমে আসা বছর চারেকের মেয়েটিকে দেড় বছর ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে এইটুকু তথ্যই মেলে। সেই সূত্র ধরেই মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলায় মান্ডিদীপের হদিস মিলেছে। বাঁকুড়ার চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটি ও রাইসেনের চাইল্ড লাইনের কর্মীদের লাগাতার খোঁজখবরে সেই মেয়ে এ বার ঘরের পথে।

প্রথম প্রথম মুখ খুলতেই চায়নি শিশুটি। অনেক চেষ্টায় সে জানায়, তার নাম ‘দুর্গা’। বাবা-মায়ের নাম ‘শঙ্কর’ ও ‘সালমা’। কিন্তু বাড়ি কোথায়? আবার চুপ মেয়ে। বাঁকুড়া জেলা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি দুর্গার পরিচয় জানতে দ্বারস্থ হয় সিআইডি-র। দেড় বছর পেরোলেও তারা দুর্গার পরিচয় জানাতে পারেনি। তবে বসে থাকেননি ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্যেরা।

অসহায় শিশুদের পাশে থাকতে সমাজকল্যাণ দফতর চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটি গড়েছে। হোমগুলির সঙ্গেও কমিটি যুক্ত। ওই কমিটিতে সমাজের নানা ক্ষেত্রের মানুষ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সোমা কাঞ্জিলাল ও শীতলচন্দ্র প্রামাণিক দুর্গাকে পুরনো কথা মনে করানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। এর মধ্যে দুর্গাকে দত্তক চেয়ে ছাতনার হোমে অনেক দম্পতির আবেদন জমা পড়তে থাকে। কিন্তু দুর্গাকে দত্তক দিতে নারাজ চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি। শীতলচন্দ্রবাবু জানান, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দুর্গা তাঁদের কাছে বাড়ির ঠিকানা হিসেবে ‘মান্ডিদীপ’-র নাম উচ্চারণ করে। এ-ও জানায়, সেখানে একটি নদী রয়েছে। নদীর নাম অবশ্য বলতে পারেনি সে। শীতলচন্দ্রবাবু বলেন, “ইন্টারনেটে মান্ডিদীপের খোঁজ শুরু করা হয়। ওই নামের একাধিক জায়গা উঠে আসে। সেখান থেকে নদী ধরে খোঁজ করে মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার মান্ডিদীপের খোঁজ পাওয়া যায়। এর পরেই আমরা গত মে মাসে রাইসেন জেলার চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে দুর্গার ছবি পাঠিয়ে ওর বাবা-মার খোঁজ করতে অনুরোধ জানাই।” যোগাযোগ করা হয় রাইসেনের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গেও।

নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকের অধীনে ‘চাইল্ড লাইন’ ১৮ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের সমস্যায় পাশে দাঁড়ায়। তারা পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে। গত জুন মাসে রাইসেনের চাইল্ড লাইন থেকে ফোনে বাঁকুড়ার চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটিকে জানানো হয়, দুর্গার প্রকৃত নাম ‘নিকিতা’। সে মামার বাড়ি মান্ডিদীপে থাকত। তবে তার বাড়ি রাজগড় জেলার নরসিংগড় থানা এলাকায়। দুর্গার ছবি দেখে মামা জানিয়েছেন, মেয়েটি তাঁদের হারিয়ে যাওয়া নিকিতা হলেও হতে পারে। কিন্তু দুর্গাই যে সেই নিকিতা, তা নিয়ে তিনি কোনও রকম উৎসাহ দেখাননি বলে রাইসেনের চাইল্ড লাইন বাঁকুড়ায় খবর পাঠিয়েছে। নিকিতার বাবা সব্জি বিক্রেতা রামশরণ সাহু-কে মেয়েটির ছবি দেখানো হয়েছে। ছবি দেখে ওই মেয়ে যে তাঁদেরই হারিয়ে যাওয়া নিকিতা, তা জোর গলায় বলেননি তিনিও। তবে রাইসেনের আধিকারিকরা এলাকার পরিস্থিতি দেখে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এক প্রকার নিশ্চিত, দুর্গা আসলে নিকিতাই। পাঁচ সন্তানের বাবা রামশরণবাবু সম্ভবত দারিদ্র্যের কারণে ওই মেয়েকে মামারবাড়িতে রেখে এসেছিলেন। এখন ফেরৎ পেয়েও সেই কারণেই ঘরে তুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

এর মধ্যে দুর্গাকে বাঁকুড়া শহরের কেঠারডাঙার হোমে নিয়ে আসা হয়। রাইসেনের চাইল্ড লাইনের পাঠানো রামশরণ ও তাঁর স্ত্রী মনোরমার ছবি দেখে দুর্গা ‘আমার মা’ বলে কেঁদে ফেলে। এরপর গড়গড় করে বলতে শুরু করে পরিবারের কথা। বাঁকুড়া চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটি জানায়, রামশরণবাবুর পরিবার সম্পর্কে যা তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তার সঙ্গে মিলে যায় দুর্গার তথ্যও। বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের এক আধিকারিক বলেন, “ও কী ভাবে এখানে এসেছে পরিষ্কার ভাবে জানাতে পারছে না। তবে মনে হয়, কেউ ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছিল।”

বাঁকুড়া জেলা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান সেখ মুরসালিন বলছেন, “দুর্গা আসলে নিকিতাই। বাঁকুড়া জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে ওকে কড়া নিরাপত্তা দিয়ে রাজগড় চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির কাছে পাঠাতে বলেছি।” তবু দারিদ্র্যের জন্য ওকে বাবা-মা যদি ফিরিয়ে না নেয়? দুর্গাকে পাঠানোর মুখে এই আশঙ্কাই বাঁকুড়া চাইল্ড লাইনের কর্মীদের মনে কাঁটার মতো বিঁধছে। মুরসালিন জানান, সে ক্ষেত্রে ওকে যাতে এলাকারই কোনও হোমে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, সে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE