কালীপুজোর জন্য সোনামুখীর নামডাক রয়েছে জেলার বাইরেও। এই শহরের কালীপুজো দেখতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। এলাকার বিভিন্ন ক্লাব বারোয়ারি পুজোর আয়োজন করে। জাঁকজমকে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। তারই পাশাপাশি, প্রবীণ থেকে নবীনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলে বিভিন্ন পুরনো পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জনশ্রুতির উত্তরাধিকার। প্রজন্মের দূরত্ব পারাপার করে বছর বছর চলে যায় কালীপুজোর দিনগুলো।
শহরের ‘মা-ই-ত-মা’-এর পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বর্গি হানার কাহিনি। কথিত আছে, একবার বর্গি দস্যুরা ওই মন্দিরে চড়াও হয়। খড়্গ দিয়ে তারা পুরোহিতের মাথা কাটতে যাবে, এমন সময় দলের সর্দার হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। দস্যুদের মধ্যে শোরগোল পড়ে যায়। পুরোহিত তখন গিয়ে দেবীর ঘট থেকে জল নিয়ে ছিটিয়ে দেন সর্দারের চোখে। আবার তার দৃষ্টি ফিরে আসে। দুর্ধর্ষ দস্যু ভক্তিতে চিৎকার করে ওঠে, ‘‘মা-ই তো! মা!’’ তার থেকেই দেবীরও এমন নামকরণ হয়ে যায়। পুরশহরের অন্যতম প্রাচীন পুজো এ’টি। পুজো কমিটির কোষাধ্যক্ষ শ্রীকান্ত দে-র দাবি, বর্গিদের বহু নিদর্শন এখনও মন্দিরে রয়েছে।
সোনামুখীর অলিগলিতে ছড়িয়ে রয়েছে এমনই অনেক প্রাচীন পুজো। শহরের হট্নগর কালীমাতার পুজো চারশো বছরেরও বেশি পুরনো। পুজো কমিটির সম্পাদক দেবমাল্য হালদার জানান একটি অভিনব জনশ্রুতির কথা। এলাকার এক বৃদ্ধা বড়জোড়ার কোনও গ্রামে ধান বিক্রি করতে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় এক বালিকা তাঁর কাছে আবদার করে, তাকে কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। তিনি তাই করেন। পাড়ায় ফিরে, নামাতে গিয়ে দেখেন, কোথায় বালিকা! একটি পাথরের খণ্ড রয়েছে তাঁর কাঁধে। সেই শিলা একটি আকড় গাছের নীচে প্রতিষ্ঠিত করে পুজো শুরু করেন এক হঠযোগী। সেই থেকেই গ্রামের নাম হয় হট্নগর। দেবীর নাম হয় হট্নগর কালীমাতা।
ধর্মতলা এলাকার রায়বাড়ির ‘ক্ষ্যাপা কালী’ শিকল দিয়ে বাঁধা। রায়বাড়ির প্রবীণ সদস্য তথা সেবাইত নির্মলকুমার রায় জানান, ৫০০ বছরেরও আগে তাঁদের এক পূর্বপুরুষকে ত্যাহ্য পুত্র করা হয়। সিউড়ি থেকে তিনি পরিবার নিয়ে চলে আসেন সোনামুখীর ধর্মতলায়। সেখানে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। কথিত রয়েছে, একবার পুজোর সময়ে কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে দেবী বালিকার রূপ ধরে মন্দির থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই থেকে বিগ্রহের পায়ে শিকল দিয়ে ধরে রাখা হয়।
ধর্মতলা সংলগ্ন গড়গড়িয়ায় শতাব্দী প্রাচীন পায়রা কালীর পুজো। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মোহনলাল সিংহ জানান, আগে পুজোয় পায়রা বলি দেওয়া হত। সেই চল উঠে গিয়েছে। থেকে গিয়েছে নামটা। ওই এলাকাতেই মুখোপাধ্যায় বাড়ির দেবী গহনাদেবী নামে পরিচিত। পরিবারের সদস্য বনমালী মুখোপাধ্যায় জানান, এক কালে বিগ্রহ গহনা দিয়ে মোড়া থাকত। বড়কালীতলার শতাব্দী প্রাচীন পুজোর দেবী মূর্তি প্রায় ১৫ ফুট উঁচু। পাশেই রয়েছে বামাকালীর মন্দির। এলাকার বাসিন্দারা জানান, আগে নাকি ডাকাতেরা বামাকালীর পুজো করত। পরে স্বপ্নাদেশে এলাকার এক বাসিন্দা নতুন মন্দির গ়ড়ে পুজোর প্রচলন করেন। প্রথমে এটি পারিবারিক কালীপুজো ছিল। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করেন ষোলোআনার সদস্যেরা। খুব বেশি প্রাচীন না হলেও চামুন্ডা কালীতলার পুজো দেখতে ভিড় হয় ভালই। পুজোর সময় বিদ্যুতের সমস্ত আলো নিভিয়ে জ্বেলে দেওয়া হয় মশাল। সোনামুখীর অন্যতম প্রাচীন রক্ষাকালীর পুজো। ওই পুজো কমিটির সভাপতি তথা সোনামুখি পুরসভার কাউন্সিলর তপনজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় জানান, প্রাচীন প্রথা মেনে পুজো হয়। কিন্তু আয়োজনে থাকে পুরদস্তুর আধুনিকতা।
বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা ইতিহাসবিদ চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত অবশ্য এই পুজোগুলির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলির সত্যতা নিয়ে নিঃসংশয় নন। তাঁর কথায়, ‘‘সোনামুখীর কালীপুজোগুলি অতি প্রাচীন। এগুলি নিয়ে কোনও লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই। যা রয়েছে তা মানুষের মুখে মুখে। তবে তথ্যের ঠিক ভুলে এগুলির বিচার চলে না।’’ তাঁর মতে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের হাত ধরে এই সমস্ত গল্প বেঁচে থাকে। প্রতিটি প্রজন্মের জীবন যাপন, আদর্শ একটু একটু করে মিশে যায় মুখে মুখে বয়ে চলা এই গল্পগুলিতে। চিত্তরঞ্জনবাবুর মতে, পরম্পরার অন্য ইতিহাস এই জনশ্রুতিতে মিলেমিশে থাকে স্থান, কাল। তারই টান পাল্লা দেয় মস্ত পুজোর রংবাহারের সঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy