Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ঢিল ছুড়লে মেলে মেলায় ঢোকার ছাড়পত্র

মেলার শুরু থেকেই স্বেচ্ছায় অলিখিত ওই নিয়ম মেনে চলেছেন ক্রেতা-বিক্রেতা, ধনী-দরিদ্র সহ সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ।

ঐতিহ্য: ময়ূরেশ্বরের ঢেকায়। ছবি: কল্যাণ আচার্য

ঐতিহ্য: ময়ূরেশ্বরের ঢেকায়। ছবি: কল্যাণ আচার্য

অর্ঘ্য ঘোষ
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২২
Share: Save:

এ যেন প্রেক্ষাগৃহে ঢোকার আগে দ্বাররক্ষীর হাতে টিকিট জমা দেওয়া। ময়ূরেশ্বরের ঢেকার ব্রহ্মদৈত্যের মেলায় ঢোকার আগে নৈবেদ্য হিসেবে সবাইকেই দিতে হয় একটি করে মাটির ঢিল। মেলার শুরু থেকেই স্বেচ্ছায় অলিখিত ওই নিয়ম মেনে চলেছেন ক্রেতা-বিক্রেতা, ধনী-দরিদ্র সহ সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ। মেলা ঢোকার মুখে সবাই মাঠ থেকে কুড়িয়ে নেন একটা ঢিল। তারপর সেই ঢিল মেলাতলার পাকুরগাছ সংলগ্ন ‘ঢেলা ফেলা’ নামে চিহ্নিত একটি জায়গায় ফেলে তবেই মেলায় প্রবেশ করেন সবাই।

কেন এই সংস্কার?

এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এলাকায় সর্বাধিক প্রচলিত যে জনশ্রুতি রয়েছে সেটি হল, বহু বছর আগে পয়লা মাঘ ঢেকা গ্রামে এক ব্রাহ্মণ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অপঘাতে মৃত্যুজনিত কারণে তিনি নাকি ব্রহ্মদৈত্য হন। কোনও কারণে পাছে তার কোপে পড়তে হয়, সেই আশঙ্কায় গ্রাম থেকে দূরে একটি পুকুরপাড়ে পাকুর গাছের নিচে তাঁর পুজো প্রতিষ্ঠা করে মেলার সূচনা করেন গ্রামবাসী। ব্রহ্মদৈত্যের ঠাঁই হয় সেই পাকুর গাছে। সেই সময় পাকুড় গাছের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে তার গোড়ায় ব্রহ্মদৈত্যের নৈবেদ্য
হিসেবে মেলায় আসা মানুষজনদের একটি করে ঢিল এনে দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। বছরের পর বছর ওই ঢিল জমা হতে হতে বর্তমানে পাকুড় গাছ সংলগ্ন এলাকা বড়োসড়ো চত্বরে পরিণত হয়েছে।

এ দিনও ডাঙ্গাপাড়ার প্রসাদি ধীবর আর তার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া নাতনি অনুশ্রীকে ঢিল নিয়ে মেলায় ঢুকতে দেখা গেল। দিদি লক্ষ্মীর সঙ্গে ‘ঢেলাফেলা’য় ঢিল ছুড়তে দেখা গেল ওই গ্রামেরই একাদশ শ্রেণির ছাত্রী অপর্ণা ধীবরকে। তাঁরা জানান, দীর্ঘ দিন ধরেই ‘ঢেলা ফেলা’য় ঢিল দিয়ে তবেই মেলায় ঢোকেন। এক দিনের ওই মেলা ঘিরেই এলাকার ৪০/৫০টি গ্রামে উৎসাহের অন্ত নেই। বিশেষ করে মেলায় বিক্রির জন্য কুটির শিল্পীরা মাসখানেক আগে থেকেই তাঁদের শিল্পসামগ্রী তৈরি করতে শুরু করেন। সোমবার ভোর থেকেই তাঁরা সেই সব শিল্পসামগ্রী নিয়ে ভিড় জমান মেলায়।

এ বারও অন্যথা হয়নি। কুমারপুরের গোপাল কর্মকার এসেছিলেন লোহার সামগ্রী নিয়ে। কাঠের তৈরি খেলনা সহ অন্য সামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন তিলডাঙার রামকৃষ্ণ সূত্রধর। উলকুণ্ডার রমেশ পাল এনেছিলেন মাটির হাঁড়িকুড়ি। তাঁরা বলেন, ‘‘আধুনিক সভ্যতার দাপটে আমাদের তৈরি শিল্পসামগ্রীর কদর তো আর নেই বললেই চলে। কিন্তু, একদিনের এই মেলায় ভালই বিক্রিবাটা হয়। বাড়তি দু’পয়সা রোজগার হয়।’’ লোকপাড়ার সাধন দলুই, বহড়ার ইচ্ছামতী বিত্তাররা জানান, পুরুষানুক্রমে এই মেলায় বিক্রির জন্য মাসখানেক আগে থেকে শিল্প সামগ্রী তৈরি করে রাখেন। ওই সব জিনিসপত্র বিক্রি করাও হয়। নিজেদের মেলা দেখাও হয়। তারপর ছেলেমেয়ে, বাড়ির লোকেদের জন্য কিছু একটা কিনে নিয়ে তবে বাড়ি ফেরেন।

একই বক্তব্য লোকপাড়ার খাবারের দোকানদার সনৎ দলুই, ময়ূরেশ্বরের মিষ্টির দোকানদার চন্দন গুঁইদেরও। তাঁরা বলেন, ‘‘রবিবার বিকেল থেকে এসে চালাঘর তৈরি করে আছি। রাতে সবাই পিকনিকের মতো রান্না করে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেছি। লাভ যাই হোক না কেন। এই আনন্দের টানেই ছোটবেলা থেকেই মেলায় দোকান নিয়ে আসি।’’

এ বারের মেলায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি ছিল চোখে পড়ার মতো। পুলিশকর্মী, সিভিক ভলেন্টিয়ার্সদের নিয়ে মেলা চত্বরে চক্কর কাটতে দেখা গিয়েছে ময়ূরেশ্বর থানার ওসি চয়ন ঘোষকে। ঢেকার স্বাধীন মণ্ডল, দুকড়ি মণ্ডলরা বলেন, ‘‘নিরাপত্তার অভাবে ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় কিছুটা বদনাম ছড়িয়েছিল। এ বার তা ঘুচবে বলেই আশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE