মাথায় মেরেকেটে সওয়া পাঁচ ফুট। রোগা টিংটিঙে অনুচ্চ চেহারার যুবার বুক চেপে ধরেছে বুট পরা পা। বেধড়ক লাঠি পেটা করতে করতে বলছে, স্বীকার কর তুই বাংলাদেশি! রাজস্থানের প্রথমনগরে পুলিশ লক-আপে অকথ্য অত্যাচারের এই বর্ণনা নিজের মুখে বলছিলেন ভুক্তভোগী আমির সেখ।
মালদহের কালিয়াচকের বাসিন্দা ২২ বছরের আমিরকে রাজস্থানে নির্যাতনের পরে পশ্চিমবঙ্গে এনে সীমান্তরক্ষী বাহিনী মারফত বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তবু হাই কোর্টে মামলা লড়ে শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে তিনি ফিরে এসেছেন। কিন্তু বীরভূমের সোনালি বিবি, সুইটি বিবিরা হাই কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও এখনও সপরিবার আটকে রয়েছেন বাংলাদেশের জেলে। শনিবার সন্ধ্যায় এপিডিআর সরাসরি সদস্য সমন্বয়ের ডাকে বীরেন রায় স্মারক আলোচনা সভায় বাংলাদেশি তকমা দিয়ে দেশ জুড়ে বাংলাভাষীদের উপরে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হল।
সুইটি বিবির ভাই আমির খান, সোনালির পড়শি সোয়েফ আলি ও বাংলাদেশি তকমায় নির্যাতিত আমির শেখ (বাঁ দিক থেকে)। শনিবার সন্ধ্যায় কলেজ স্ট্রিটে। —নিজস্ব চিত্র।
সংগঠকদের দাবি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছ থেকে পাওয়া হিসেবেই দেখা যাচ্ছে অন্তত ১৮৩ জনকে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে ‘পুশব্যাক’ করা হয়েছে। এই তালিকায় বীরভূমের সোনালি, সুইটিরা রয়েছেন। আবার অন্তত ২৪০০ জন নানা ভাবে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সোনালি, সুইটি বা আমিরের হয়ে আইনি যুদ্ধে শামিল আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তী, আফজল আনসারি, সৈকত ঠাকুরতা, শবনম সুলতানা, অমৃতা দে, সুপ্রতীক শ্যামলেরাও তাঁদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন কলেজ স্কোয়ারে ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভার অনুষ্ঠানে। আইনজীবী রঘুনাথ চক্রবর্তী বলেন, “আমিরকে রাজস্থান থেকে জবরদস্তি তেমন কোনও আইনি রায় ছাড়াই বাংলাদেশে পাঠানো হয়। সোনালি, সুইটিদের ক্ষেত্রে কিন্তু এফআরআরও-র (বিদেশি আঞ্চলিক নিবন্ধিকরণ দফতর) নির্দেশ ছিল। সম্ভবত নিজেদের মুখ পুড়বে বলেই হাই কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার দেরি করছে। হাই কোর্টের নির্দেশের সময়সীমা পেরোলেও এখনও ততটা তৎপর নয় কেন্দ্র।”
আমির এবং সুইটি, সোনালির আত্মীয়েরা অবশ্য তাঁদের পাশে দাঁড়াতে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলামের সহৃদয় চেষ্টার প্রশংসা করেন। তবে আয়োজকদের প্রশ্ন, সামগ্রিক ভাবে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গবাসী এই দুর্ভাগা, প্রধানত সংখ্যালঘু বাঙালি মুসলিমদের জন্য কতটা কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
কালিয়াচকের আমির বলছিলেন, “আমি ছাদ পেটানোর কাজ করতে বার চারেক রাজস্থানে গিয়েছি। আমার সঙ্গে আধার, স্কুলের কাগজ, জন্মের কাগজ সব ছিল। শুধু ভোটার কার্ড ছিল না। আমার সঙ্গে বাকিদের রাজস্থানের পুলিশ ছেড়ে দিলেও আমায় ছাড়েনি। আমি ভারতীয় বলায় পুলিশ ওদেরও মারে। আমি রাজস্থান পুলিশ, বিএসএফ সবার মার খেয়েছি। বাংলাদেশেও জেলে কষ্টে ছিলাম। সব সময়ে বলে গিয়েছি, আমায় মেরে ফেললেও আমি পুরোপুরি ভারতীয়!” আমিরের কথায়, “এখন কাজের খুব দরকার। কিন্তু ভয়ে রাজস্থান যাব আর ভাবতে পারছি না!”
বীরভূমের পাইকরের সোনালি এবং মুরারইয়ের সুইটি দীর্ঘদিন দিল্লিতে আছেন। তাঁরা প্লাস্টিক কুড়ানির কাজ করতেন। দু’জনেরই পরিবারের বীরভূমের পুরনো জমির কাগজও আছে। কিন্তু সোনালি, তাঁর স্বামী, ছেলে বাংলাদেশে বন্দি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে একই জেলে সুইটিও দুই ছেলেকে নিয়ে আছেন। সোনালির পড়শি সোয়েফ আলি, সুইটির মামাতো ভাই আমির খান কলকাতায় এসেছেন। সোয়েফ বলেন, “সোনালির ছ’বছরের ছোট্ট মেয়ে রোজ আমাদের কাছে এসে বলে, মাকে কবে দেখব! ও নানা-নানির কাছে রয়েছে। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোনালিকে নিয়ে সকলেই চিন্তায়। বাচ্চাটা জন্মানোর আগে সোনালি দেশে ফিরতে পারবে তো, ভেবে আকুল হচ্ছি।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)