Advertisement
০৬ মে ২০২৪
মাত্র ৫ বস্তা করে কেনায় ক্ষোভ ছড়াচ্ছে বাঁকুড়ায়

সমবায় আলু কিনছে, জানেন না চাষিরাই

একে আলুর অতি-উত্‌পাদন। অথচ হিমঘরে জায়গা বাড়ন্ত। তার উপরে প্রশাসনিক বিভ্রান্তি। দু’য়ের জেরে ঘোর সঙ্কটের মুখে বাঁকুড়া জেলার আলু চাষিরা। জেলা প্রশাসন প্রথমে জানিয়েছিল, আলু কেনা হবে হিমঘরের সামনে। তা হয়নি। পরে ঠিক হল সমবায়ের কাউন্টারে সরকারি সহায়ক মূলে (কেজি প্রতি সাড়ে ৫ টাকা) আলু কেনার কাজ হবে। উত্‌পাদনের ভিত্তিতে চাষিদের ভাগ করে আলু কেনার কথা বলেছিল প্রশাসন। তা-ও হল না।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০১:৪৪
Share: Save:

একে আলুর অতি-উত্‌পাদন। অথচ হিমঘরে জায়গা বাড়ন্ত। তার উপরে প্রশাসনিক বিভ্রান্তি। দু’য়ের জেরে ঘোর সঙ্কটের মুখে বাঁকুড়া জেলার আলু চাষিরা।

জেলা প্রশাসন প্রথমে জানিয়েছিল, আলু কেনা হবে হিমঘরের সামনে। তা হয়নি। পরে ঠিক হল সমবায়ের কাউন্টারে সরকারি সহায়ক মূলে (কেজি প্রতি সাড়ে ৫ টাকা) আলু কেনার কাজ হবে। উত্‌পাদনের ভিত্তিতে চাষিদের ভাগ করে আলু কেনার কথা বলেছিল প্রশাসন। তা-ও হল না। শুধু তাই নয়, আলু কেনা শুরু হচ্ছে, এই মর্মে প্রচারও নেই এলাকায়। তাই বহু চাষির কাছে প্রশাসনের আলু কেনার খবরই পৌঁছচ্ছে না।

সব মিলিয়ে আলু কেনাকে কেন্দ্র করে চরম বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বাঁকুড়ায়। চাষিদের ক্ষোভ, জেলা প্রশাসনের কথার সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। ব্লকে ব্লকে আলু কেনার যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে, তা সমবায়গুলির মধ্যে ভাগ করে প্রতিটি সমবায়কে আলু কেনার কোটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, সেই কোটা এতই কম যে, মাত্র গুটিকয়েক চাষির কাছ থেকে সামান্য আলুই কিনতে পেরেছে সমবায়গুলি। উত্‌পাদনের ভিত্তিতে আলু কেনা হবে বলেও কোটা মেনে গুটিকয়েক চাষির কাছ থেকে মাথাপিছু স্রেফ ৫ বস্তা করে আলু কেনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আলু বিক্রি করতে না পারা চাষিদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে সমবায়ের কর্তাদেরই। দিনের শেষে আলু চাষিদের কপালে তাই চিন্তার ভাঁজ রয়েই গেল। বিপুল পরিমাণ আলু নিয়ে কী করবেন, তা তাঁরা বুঝে উঠতে পারছে না।

যেমন জঙ্গলমহলের সারেঙ্গা ব্লকের সিদি সমবায় সমিতিকে ২০০ বস্তা আলু কেনার কোটা দিয়েছিল প্রশাসন। এই সমবায়ে চাষির সংখ্যা ৫০০। বুধবার সকালে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আলু কেনার কোটা শেষ হয়ে যায় সমবায়ে। মোট ৪০ জন চাষির কাছ থেকে পাঁচ বস্তা করে আলু কেনা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েও আলু বিক্রি করতে না পেরে অনেক আলু চাষি তাঁদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। চিলতোড় গ্রামের নিমাই গরাই, অজিত মহাপাত্ররা বলেন, “আমাদের কী লাভ হল? বাড়ি থেকে পরিবহণ খরচ দিয়ে আলু নিয়ে আসলাম সমবায়ে। অথচ বিক্রি হল না। সেই তো আলু আবার মাঠে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। ঋণ নিয়ে চাষ করতে নেমেছিলাম। আলু বিক্রি না হলে কী ভাবে শোধ করব?” কপাল ভাল হওয়ায় তবু পাঁচ বস্তা করে আলু বিক্রি করতে পেরেছেন চিলতোড় গ্রামের চাষি মধূসুদন মহাপাত্র, সন্দীপ মহাপাত্রেরা। কিন্তু তাতেও তাঁরা চিন্তামুক্ত হচ্ছেন কই? মধুসূদনবাবু দেড় বিঘা ও সন্দীপবাবু এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। তাঁদের কথায়, “আলু কেনার খদ্দের নেই। এ বার অঢেল আলু হয়েছে। সেখানে পাঁচ বস্তা বিক্রি করে কতটুকু আর লাভ হল আমাদের?”

কোতুলপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সহদেব কোটালের দাবি, বুধবার থেকেই এই ব্লকে আলু কেনা শুরু হয়েছে সমবায় সমিতির মাধ্যমে। মোট চারটি সমবায় সমিতি ব্লকের আটটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় আলু কেনা শুরু করেছে। যদিও ব্লকের চাষিদের একাংশ জানাচ্ছেন, আলু কেনা হচ্ছে বলে কোনও খবরই নেই তাঁদের কাছে! কোতুলপুরের রানাহাট এলাকার চাষি অমূল্য সরকার জানালেন, নগদ ৬০ হাজার টাকা সমবায়ের কাছে ঋণ নিয়ে ছ’বিঘা জমিতে আলু লাগিয়েছেন তিনি। ৪৫০ বস্তা আলু ফলন হয়েছে তাঁর। এর মধ্যে ৬০ বস্তা আলু ব্যবসায়ীদের বিক্রি করেছেন তিনি। বস্তা পিছু মূল্য পেয়েছেন ১২০ টাকা। আর এখন আলুর দাম বস্তা পিছু ৮০ টাকা। অমূল্যবাবুর কথায়, “সরকারি স্তরে সাড়ে ৫ টাকা কেজি দরে আলু কেনা হচ্ছে, এই খবরই আমার জানা নেই! আমাদের গ্রামের কেউই তো আলু বিক্রি করতে সমবায় সমিতিতে যায়নি।” এই ব্লকেরই বাগডোবা গ্রামের চাষি তারাপদ গরাই বলেন, “মাঠে আলু কেনার লোক নেই। হিমঘরে আলু রাখা যাচ্ছে না। ব্লক অফিসে গিয়েছিলাম আলু কেনা হবে কিনা, জানতে। কিন্তু কেউ তো জানালো না আলু কেনা হচ্ছে বলে।” প্রতাপপুরের আলুচাষি শেখ সামসুদ্দিনের ক্ষোভ, “আত্মীয়দের গয়না বন্ধক দিয়ে চাষের টাকা নিয়েছি। এত দিনে গয়না ছাড়িয়ে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তাঁরা খুব চাপ দিচ্ছেন। সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছি না। কী করে গয়না ফিরিয়ে আনব, ভেবে কূল পাচ্ছি না।”

বিষ্ণূপুরের মহকুমা শাসক পলাশ সেনগুপ্তের দাবি, সব কটি ব্লকেই আলু কেনা শুরু হয়েছে জেলাশাসকের নির্দেশে। যদিও এসইউসি-র কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের জেলা সম্পাদক দিলীপ দে-র বক্তব্য, “আলু কেনার নামে প্রহসন ছাড়া কিছুই হল না। বুধবার বিষ্ণুপুর ব্লকের কোথাও আলু কেনা হয়েছে বলে খবর পাইনি। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তাঁরাও জানেন না কোথায় আলু কেনা হচ্ছে। তা হলে প্রশাসন এমন দাবি করে কী করে!”

বিক্ষিপ্ত ভাবে সমবায়গুলিতে আলু কেনা শুরু হয়েছে। ওন্দা ব্লকে এ দিন গুঁই নন্দী কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি এবং এলএস সমবায় সমিতি আলু কিনেছে বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। গুঁই নন্দী ৭৪ বস্তা এবং অন্য সমিতিটি ১৪৫ বস্তা আলু কেনার বরাত পেয়েছে জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে। গুঁই নন্দী সমবায় সমিতিতে প্রায় তিন হাজার চাষি রয়েছেন। চলতি মরসুমে আলু চাষের জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে চাষিদের। এই সমবায়ে আলু কেনা হবে খবর ছড়িয়ে পড়তেই বহু চাষি এ দিন ভিড় জমান সমবায়ের কাউন্টারে। কিন্তু কোটা যে মাত্র ৭৪ বস্তার! প্রতি চাষির কাছ থেকে পাঁচ বস্তা করে আলু নেওয়া হবে। তাই হাতে গোনা কয়েক জনই আলু বিক্রি করার সুযোগ পাবেন এখানে। এই ঘটনার জেরে চাষিদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে সমবায় সমিতির কর্তাদের। একই ছবি এলএস সমবায় সমিতিতে। গুঁই নন্দী কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির ম্যানেজার গৌরাঙ্গ ঘোষাল বলেন, “আমাদের কিছু করার নেই। চাষিদের বুঝিয়েছি। তবে আলু বিক্রি করতে না পারায় পায়ের নীচ থেকে মাটি হারিয়ে গিয়েছে তাঁদের। প্রশাসন আরও কিছু আলু কিনলে ভাল হয়।”

ফরওয়ার্ড ব্লকের কৃষক সংগঠন অগ্রগামী কিষান সভার জেলা সম্পাদক মানিক মুখোপাধ্যায় বলেন, “চাষিদের বোকা বানানো হল। এই সরকারের আসলে চাষিদের বাঁচানোর কোনও ইচ্ছাই নেই। তাই নামমাত্র লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আলু কিনতে নেমে আখেরে নিজেদের মুখ লুকোতে চাইছে রাজ্য সরকার।” আলু কেনা নিয়ে চাষিদের জানাতে কী ভাবে প্রচার করা হয়েছে? কেন হিমঘরের সামনে আলু কেনা হবে বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল? উত্‌পাদনের ভিত্তিতে আলু কেনা হবে বলেও কেন সব চাষির কাছ থেকে সমান সংখ্যক আলু কেনা হল? এই সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি জেলাশাসক বিজয় ভারতীর কাছে। এ দিন তাঁকে ফোন করা হলে ‘বৈঠকে আছি, পরে করুন’ বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bankura potato
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE