জয়ের আনন্দ। রঘুনাথপুরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী সুলেখা দাস।
হাঁকডাক সবই ছিল। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সুরে ‘ভাগ মদন’ বলে পুরপ্রধানকে সরানোর ডাকও যথারীতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইভিএমে মানুষের রায় জানিয়েদিল তাঁর মদনদেরই চান।
লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে রঘুনাথপুর পুরএলাকায় বিজেপি দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে উঠে আসায় এ বার পুরসভা দখলের স্বপ্ন দেখেছিল দল। বিজেপির জেলা সভাপতি বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় সভা করতে এসে ডাক দিয়েছিলেন, ‘ভাগ মদন ভাগ’ (পুরসভার বিদায়ী পুরপ্রধান মদন বরাট)। কিন্তু মঙ্গলবারের ফল প্রকাশের পরে তৃণমূলের কর্মীরাই এ বার পাল্টা বলছেন, ‘ভাগ বিকাশ ভাগ’। তৃণমূলের এই জয় দেখে মুখে কুলুপ বিকাশবাবুর। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই হারের কারণ আমরা বিশ্লেষণ করে দেখব।’’
আর জয়ের পরে তৃণমূল কর্মীরা বলছেন, এই ফল দেখিয়ে দিল, শিল্প না হওয়ার ক্ষোভ তৃণমূলের সমর্থন ক্ষয় করতে পারেনি। এই ভোট জানিয়ে দিল, টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলের পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধী মনোভাব এখনও ততটা জমাট বাঁধেনি। এই ভোট জানিয়ে গেল, দলের টিকিট না পেয়ে যাঁরা গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা কোনও ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেননি। রঘুনাথপুর কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরির প্রতিক্রিয়া, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চার বছর ধরে ধারাবাহিক উন্নয়ন চলছে রাজ্য জুড়ে। বিরোধীদের তোলা হাজারো অভিযোগ, অপপ্রচার স্বত্ত্বেও মানুষ তাঁরই উপরে ভরসা করছে। এই ফল তারই প্রতিফলন।”
রঘুনাথপুরে নির্বাচনের আগে দলগত বিন্যাস ছিল: তৃণমূল ১০, সিপিএম ২ ও কংগ্রেস ১।
এ বার ওয়ার্ড কমলেও তৃণমূল বোর্ড দখলের ‘ম্যাজিক ফিগার’ ৮টি ওয়ার্ড দখল করে নেয়। সিপিএমের ওয়ার্ড বেড়ে হয়েছে ৩টি, কংগ্রেস ১টি ধরে রাখলেও বিজেপি মাত্র ১টি ওয়ার্ড পেয়েছে। প্রসঙ্গত ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল ও সিপিএমের প্রার্থী সমসংখ্যক ভোট পাওয়ায় ওই ওয়ার্ডের প্রার্থীর জয়পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে লটারির মাধ্যমে। রঘুনাথপুরের মহকুমাশাসক সুরেন্দ্রকুমার মিনা বলেন, ‘‘৭ নম্বর ওয়ার্ডে দুই দলের প্রার্থী একই সংখ্যক ভোট পাওয়াতে বিধি অনুযায়ী লটারি করা হয়েছিল। তাতে জিতেছেন তৃণমূলের প্রার্থী বেলা বাউরি।” অথচ একবছর আগে লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে এই শহরের ৫টি ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে ছিল। এমনকী বিদায়ী পুরপ্রধানের ওয়ার্ডেও বিজেপি এগিয়ে ছিল। সেই ফলের নিরিখেই এ বার প্রচার চড়া করে বিজেপি।
রঘুনাথপুরে পুরনির্বাচনে এ বার ভোটের হার ভাল হওয়ায় ফল নিয়ে দোলাচলে ছিল সব শিবিরই। তবে শেষ হাসি হাসল তৃণমূলই। বস্তুত নির্বাচনে শাসকদলের ভাগ্য এ বার ভালই। লটারির মাধ্যমে একটি ওয়ার্ডে জেতাই শুধু নয়, ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়েই আটটি ওয়ার্ডে জিতেছে তৃণমূল। বিরোধীদের মধ্যে সেই পুরনো ভোট ভাগাভাগির অঙ্কেই বাজিমাত করেছে শাসকদল। ঘটনা হল নির্বাচনের ফলের দিকে চোখ রাখলেই স্পষ্ট বিরোধী ভোট ভাগাভাগির সুবিধা পেয়েছে শাসকশিবির। জেতা আটটি ওয়ার্ডের মধ্যে কোনওটিতেই নির্দিষ্ট একটি দলের সাথে লড়তে হয়নি তৃণমূলকে। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের সাথে তাদের লড়াই হয়েছে দু’টি করে ওয়ার্ডে। বিজেপির সাথে তৃণমূলের লড়াই হয়েছে তিনটিতে। আবার নির্দল তথা বিক্ষুব্ধ প্রার্থীর সাথে একটি ওয়ার্ডে লড়াই হয়েছে শাসকদলের। ফলে রাজনৈতিক মহলের মতে বিরোধীভোট নির্দিষ্ট একটি দলের পক্ষে না যাওয়াতেই সুবিধা পেয়েছে তৃণমূল।
১ নম্বর ওয়ার্ডে বিরোধী ভোট বাকি পাঁচটি দলের মধ্যে ভাগাভাগি হওয়াতে রেকর্ড ভোটে জিতেছেন যুব নেতা ভবেশ চট্টোপাধ্যায়। আবার সিপিএম ও বিজেপির মধ্যে ভোট কাটাকুটির অঙ্কে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে মাত্র ৬টি ভোটে জিততে সমর্থ হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী। দলের নির্বাচনী কমিটির সদস্য তথা যুব তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি প্রণব দেওঘরিয়া বলেন, ‘‘পরিকল্পনা মাফিক ভোট করানোর জন্যই লোকসভার তুলনায় পুরনির্বাচনে আমাদের ভোট বেড়েছে এবং ভোট কমেছে বিজেপি ও বামেদের।” তবে বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস তিনদলেরই অভিযোগ, নির্বাচনে টাকা ছড়িয়ে জিতেছে তৃণমূল। যদিও নির্বাচনের পরে বা আগে এই অভিযোগ তাদের মুখে শোনা যায়নি। বিরোধীদের দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন বিধায়ক।
অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হল, লোকসভায় বামেদের পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল বিজেপি। পুরনির্বাচনে বামফ্রন্ট ও বিজেপি দুই দলেরই ভোট কমলেও রক্তক্ষরণ বেশি হয়েছে গেরুয়া শিবিরের। লোকসভার তুলনায় তাদের ভোট কমেছে কমবেশি ৫ শতাংশ। অবশ্য গোটা জেলাতেই ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির। রঘুনাথপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। জেলার তিন পুরসভার একমাত্র বিজেপির কাউন্সিলর হলেন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শুভঙ্কর কর। অন্যদিকে ভোট কমলেও গতবারের মতই তিনটি আসনে জিতেছে বামফ্রন্ট। গতবার তৃণমূলের সাথে জোট করে একটি আসনে জিতলেও এ বার কার্যত মুছে গেছে আর এক বামদল এসইউসি।
তৃণমূলকে ভুগিয়েছে গোঁজ কাঁটা। জয়ের পরে দলের নেতাদেরই বলতে শোনা গেছে, বিক্ষুব্ধ প্রার্থীরা না থাকলে আরও দু’টি ওয়ার্ডে জয় নিশ্চিত ছিল। এবং ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট ৫ ও ৮ নম্বরে ভোট কেটে দলীয় প্রার্থীর জয় আটকেছেন বিক্ষুব্ধরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy