Advertisement
E-Paper

আজ পুরুলিয়ার জন্মদিন

১৯৫৬ সালের আজকের দিনে (১ নভেম্বর) মানভূমের খণ্ডিত অংশ বিহার থেকে যুক্ত হয়েছিল পশ্চিমবাংলার সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে যুক্ত হয়েছিল নতুন একটি জেলা— পুরুলিয়া। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল লোকসেবক সঙ্ঘ। 

প্রশান্ত পাল

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৪৩
ফিরে-দেখা: শিল্পাশ্রমের একটি ঘরে এ ভাবেই পড়ে রয়েছে জেলার ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি। ছবি: সুজিত মাহাতো

ফিরে-দেখা: শিল্পাশ্রমের একটি ঘরে এ ভাবেই পড়ে রয়েছে জেলার ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি। ছবি: সুজিত মাহাতো

দেওয়াল জুড়ে মানচিত্রের মতো ফাটল। কোথাও দেওয়ালের ফাটলে বাসা বেঁধেছে উই। সেই দেওয়ালের পাশে কাঠের খোলা আলমারিতে ঠাসা নানা ফাইল, বইপত্র। বিবর্ণ টেবিলেও ডাঁই করা রয়েছে নথিপত্র। কোনও কোনও ফাইলের উপরে ফাউন্টেন পেনে লেখা শিরোনাম বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়েছে। পুরুলিয়ার ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত শিল্পাশ্রমের একটি ঘরে এ ভাবেই বন্দি রয়েছে জেলার ইতিহাসের নানা নথি।

১৯৫৬ সালের আজকের দিনে (১ নভেম্বর) মানভূমের খণ্ডিত অংশ বিহার থেকে যুক্ত হয়েছিল পশ্চিমবাংলার সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে যুক্ত হয়েছিল নতুন একটি জেলা— পুরুলিয়া। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল লোকসেবক সঙ্ঘ।

সঙ্ঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে করাচি অধিবেশনে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন করা হবে। তাই স্বাধীনতার পরে বিহার থেকে বাংলাভাষী মানভুমকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ওঠে। মানভূম কংগ্রেসের নেতৃত্বের একটা বড় অংশই এই দাবিতে সরব হন। এ নিয়ে মানভূম কংগ্রেসের নেতৃত্বের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় ১৯৪৮ সালে লোকসেবক সঙ্ঘের জন্ম হয়। সঙ্ঘের নেতৃত্বেই মানভূমে ভাষা আন্দোলন তীব্র হয়েছিল। বাংলা ভাষী মানুষের সেই আন্দোলনেরই ফসল পুরুলিয়া।

গাঁধীজির অহিংস ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মানভূম কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতৃত্ব তথা তৎকালীন লোকসেবক সঙ্ঘের নেতৃত্বের প্রায় সমস্ত কাজকর্মই পরিচালিত হত শিল্পাশ্রম থেকে। জেলার জন্মদিনে সেই আশ্রম কাটাবে আঁধারেই। নেই প্রশাসনের নজর। আসেনি বিদ্যুৎ সংযোগ। আশ্রমকে ঘিরে জন্মেছে আগাছা। একদা বিভিন্ন গুণীজনেরা যেখানে বৈঠক করে গিয়েছেন, সেই ঋষি নিবারণ স্মৃতি মন্দিরের ছাদ ভেঙে পড়েছে। দেওয়াল জুড়েও অজস্র ফাটল।

আশ্রম তৈরি হয়েছিল অবশ্য অনেক আগেই। ১৯২৫ সালে এখান থেকেই প্রকাশিত হয় মুক্তি পত্রিকা। পরাধীন ভারতে এই পত্রিকায় লেখার দায়ে একাধিকবার জেলে যেতে হয়েছিল নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত ও লাবণ্যপ্রভা দেবীর। জেলাবাসী তাঁদের ‘ঋষি’ ও ‘মানভূম জননী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁদের স্মৃতি জড়িয়ে থাকা ও ভাষা আন্দোলনের বহু নথি তাই এখনও আশ্রমের জীর্ণ ঘরে জমে রয়েছে। সুশীলবাবুরাই মাঝে মধ্যে জেলার অমূল্য ইতিহাসের পাতায় জমে থাকা ধুলো ঝাড়েন।

সুশীলবাবু জানান, ২০০৪ সালে ঝড়ে আশ্রমের বেশ কয়েকটি ঘরের অ্যাসবেস্টর্সের ছাদ উড়ে যায়। ঝড়ে কয়েকটি ঘরের দেওয়ালও ভেঙে পড়ে। সেই সময়েই বেশ কিছু মূল্যবান নথিপত্র নষ্ট হয়। তাঁর কথায়, ‘‘এখনও মুক্তি পত্রিকার প্রায় সমস্ত সংখ্যাই ফাইলবন্দি রয়েছে। রয়েছে ঋষি নিবারণচন্দ্রের নিজের লেখা ডায়েরি। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-সহ বিশিষ্ট মানুষজনের চিঠিপত্রও রয়েছে। এ ছাড়া, লোকসেবক সঙ্ঘের নানা বইপত্র, কাজকর্মের দলিলও রয়েছে।’’

তিনি জানান, লাবণ্যপ্রভাদেবীর ছেলে অরুণচন্দ্র ঘোষ এ সবের দেখভাল করতেন। তাঁর মৃত্যুর সুশীলবাবুরাই ওই সব নথি আঁকড়ে রয়েছেন। তিন বলেন, ‘‘চেষ্টা করছি এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করার। একটি ঘরের সংস্কার চলছে। কিন্তু, অর্থাভাবই আমাদের প্রধান সমস্যা।’’

জেলার ইতিহাস গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামী বলেন, ‘‘শিল্পাশ্রম পুরুলিয়ার ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। ওই সব নথির সঙ্গেই আশ্রমটিও পরম যত্নে রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তা হচ্ছে না।’’ এই আশ্রমের জন্য জমি দান করেছিলেন পুরুলিয়া শহরের বিদ্যোৎসাহী মানুষ হরিপদ দাঁ। তাঁর উত্তরসূরী দেবকুমার দাঁ বলেন, ‘‘পুরুলিয়ার ইতিহাস বিজড়িত ওই আশ্রম দীর্ঘদিন ধরে অযত্নে পড়ে রয়েছে। খারাপ লাগছে। এক দিন হয়ত নথিপত্র হারিয়ে যাবে। প্রশাসনেরই উচিত এই ইতিহাসকে রক্ষা করা।’’

সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গবেষকদের কাছে এই দলিলগুলির মূল্য অনেক। এখান থেকেই হয়ত আলোয় আসবে অনালোকিত ইতিহাস। জেলার ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘরের এই নথিগুলি সযত্নে রক্ষা করা প্রয়োজন।’’ ১৯৫৬ সালে পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তির দাবিতে পুঞ্চার পাকবিড়রা থেকে কলকাতা পর্যন্ত যাঁরা হেঁটেছিলেন, তাঁদের অনিযতম তথা লোকসেবক সঙ্ঘের বরিষ্ঠ সদস্য কাজল সেন বলেন, ‘‘এই ইতিহাসকে চোখের মণির মতই রক্ষা করা প্রয়োজন।’’ একই মত ঋষি নিবারণচন্দ্রের নাতি মাঝিহিড়া বুনিয়াদি শিক্ষা আশ্রমের পরিচালক প্রসাদ দাশগুপ্তেরও। পুরুলিয়ার কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই ইতিহাস রক্ষা দাবি যথাস্থানে জানাব।’’

কী বলছে প্রশাসন? জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘আশ্রম কর্তৃপক্ষ আবেদন জানালে প্রশাসন থেকে কী করা যায় দেখা হবে।’’

Purulia Birthday Manbhum
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy