Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

তিতাস দ্বিতীয়, টিভিতে নাম

কেউ ফেসবুকের পোকা, কেউ ক্রিকেট পাগল। কেউ দেবের ভক্ত, কারও আবার সিরিয়ালে নেশা। ছাত্রজীবনে ছেলেমেয়ের মধ্যে যে অভ্যাস দেখলেই মা-বাবার ভেবে নেন, সন্তান এ বার বখে গেল, এ বারের মাধ্যমিকে প্রথম সারিতে উঠে আসা পরীক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যেই সেই নেশাগুলিই চোখে পড়ছে।

পরিবারের মধ্যমণি মাধ্যমিকে রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী তিতাস দুবে। (ইনসেটে) পুরুলিয়া জেলায় মেয়েদের সম্ভাব্য প্রথম সায়নী বিশ্বাস।

পরিবারের মধ্যমণি মাধ্যমিকে রাজ্যে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী তিতাস দুবে। (ইনসেটে) পুরুলিয়া জেলায় মেয়েদের সম্ভাব্য প্রথম সায়নী বিশ্বাস।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৬ ০২:২৪
Share: Save:

কেউ ফেসবুকের পোকা, কেউ ক্রিকেট পাগল। কেউ দেবের ভক্ত, কারও আবার সিরিয়ালে নেশা। ছাত্রজীবনে ছেলেমেয়ের মধ্যে যে অভ্যাস দেখলেই মা-বাবার ভেবে নেন, সন্তান এ বার বখে গেল, এ বারের মাধ্যমিকে প্রথম সারিতে উঠে আসা পরীক্ষার্থীদের অনেকের মধ্যেই সেই নেশাগুলিই চোখে পড়ছে।

টিভিতে ইংরেজি সিনেমা দেখতে ভালবাসে সিমলাপালের মঙ্গলময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী তিতাস দুবে। কিন্তু খবরের চ্যানেল তার মোটেই পছন্দের নয়। কিন্তু এ দিন সকালে সেই খবরের চ্যানেল খুলতেই থ হয়ে গিয়েছিল সে। ‘ব্রেকিং নিউজে’ যে তার নিজের নাম! মাধ্যমিকে ৬৮২ নম্বর পেলে সে রাজ্যে দ্বিতীয় হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, রাজ্যে মেয়েদের মধ্যে যৌথ ভাবে প্রথম!

গোটা স্কুল জীবনে কখনও দ্বিতীয় না হওয়া কৃতি মেয়েটির কথায়, ‘‘পরীক্ষা ভাল দিয়েছিলাম। ফলও ভাল হবে জানতাম। তা বলে এত নম্বর পাব ভাবিনি। তাই টিভিতে নিজের নাম শুনে প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারিনি।’’ টেস্ট পরীক্ষায় ৬৬৪ নম্বর পাওয়া তিতাস অবশ্য অনেকের বিস্ময় তৈরি করার মতোই নম্বর পেয়েছে মাধ্যমিকে। বিজ্ঞানের তিনটি বিষয়ে একশোয় ১০০। বাংলায় ৯৩, ইংরাজিতে ৯৪, ইতিহাসে ৯৭ ও ভূগোলে ৯৮।

তার বাবা সৌমেন্দ্রনাথ দুবে স্থানীয় লক্ষ্মণপুর হাইস্কুলের জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক। মা আল্পনাদেবী সিমলাপাল মঙ্গলময়ী বালিকা বিদ্যালয়েরই ভূগোলের শিক্ষিকা। শিক্ষক পরিবারের মেয়ে তিতাস টিভিতে ইংরেজি সিনেমা দেখতে পছন্দ করে। তবে খেলাধুলো ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘‘টিভির খবরেও আমার আগ্রহ নেই। কারণ খবরে সব সময় রাজনীতির কচকচানি থাকে।’’ বড় হয়ে সে ডাক্তার হতে চায়। তিতাসের স্কুলের টিচার ইনচার্জ ঝর্না সিংহ বলেন, “তিতাস আমাদের স্কুলের গর্ব। ওর জন্য আমাদের স্কুলের পরিচিতির গণ্ডি এ বার জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যে পৌঁছে গেল।”

ওন্দা হাইস্কুলের ছাত্র বিশাল গঙ্গোপাধ্যায় মাধ্যমিকে এ বার পঞ্চম হয়েছে রাজ্যে। ওন্দা শহরের কুমারডাঙার বাসিন্দা বিশাল রাত ৯’টা বাজলেই টিভির সামনে বসে পড়ে সম্রাট অশোকের জীবনী সংক্রান্ত একটি সিরিয়ালের সামনে। কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনার নেশাও রয়েছে বিশালের। এ বারের মাধ্যমিকে ৬৭৯ নম্বর পেয়েছে সে। অঙ্ক ও ভৌতবিজ্ঞানে ১০০ নম্বরের পাশাপাশি প্রতিটি বিষয়েই ৯০-এর উপর নম্বর রয়েছে তার। বিশাল বলে, “টিভিতে সম্রাট অশোক সিরিয়াল আমি ‘মিস’ করি না। রাতের আধঘণ্টা সময় তাই আমি টিভি দেখবই। মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্যও এই রুটিন পরিবর্তন হয়নি। এ ছাড়া হেডফোনে গান শুনতেও আমার খুব ভাল লাগে।” টিভি দেখে বা হেডফোনে গান শুনে অনেকটাই চাপ হালকা হয় বলেই অভিমত তার। বিশালের বাবা বিমান গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ছেলের ফলে আমাদের শুধু নয়, তামাম ওন্দাবাসীর মাথা উঁচু হয়েছে। ছেলে বড় হয়ে চিকিৎসক হতে চায়।’’

৬৭৬ নম্বর পেয়ে পুরুলিয়া জেলা স্কুলের অনুভব চক্রবর্তী ও সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী অষ্টম স্থান দখল করেছে। ওই একই নম্বর পেয়েছে বাঁকুড়া জেলা স্কুলের অর্ঘ্য পাল ও জয়পুরের হেতিয়া হাইস্কুলের পরিচয় ভট্টাচার্য।

পুরুলিয়া শহরের মুন্সেফডাঙার বাসিন্দা অনুভব পঞ্চম শ্রেণি থেকেই পুরুলিয়া জিলা স্কুলের ছাত্র। তার কথায়, ‘‘কলকাতা নাইট রাইডার্স আমার প্রিয় দল। পরীক্ষার আগেও খেলা দেখেছি। তবে পড়ায় ফাঁকি দিয়ে নয়। এখন আইপিএল দেখছি।’’ অবসর সময়ে ফেলুদা, তোপসে ও জটায়ু অত্যন্ত প্রিয় তাঁর। ফাঁক পেলেই ফেলুদার রহস্য উন্মোচনের মধ্যে ঢুকে পড়তে ভাল লাগে তার। তার বাবা অনির্বান চক্রবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের কর্মী, মা বৈশাখীদেবী স্কুল শিক্ষক। বাবার কথায়, ‘‘ছেলের পড়াশোনার সব কিছু ওর মা দেখে।’’

অনুভবদের পৈর্তৃক বাড়ি কাঁচড়াপাড়ায়। টিভিতে ফল জানার পরে সে প্রথম খবর দেয় কাঁচড়াপাড়ার বাড়িতে দাদুকে। অনুভবের কথায়, ‘‘দাদু আমাকে ভীষন ভাবে উৎসাহ দেন। আমার ইচ্ছে ডাক্তারি নিয়ে পড়ব।’’

সৌম্যজিৎ তার দাদার মতোই ইঞ্জিনিয়র হতে চায়। তবে জেলা স্কুলে তার উচ্চমাধ্যমিক পড়া হচ্ছে না। তার গন্তব্য এ বার বাঁকুড়া জিলা স্কুল। বাবা পূর্ত দফতরের পদস্থ কর্মী। কিন্তু পুরুলিয়া থেকে তিনি মেদিনীপুরে বদলি হয়ে গিয়েছেন বলেই ঠিকানা বদল। এ দিন ফল বেরোবে বলে সাত সকালেই বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়ায় চলে এসেছিলেন সৌম্যজিৎ। ভবিষ্যতের এই ইঞ্জিনিয়ারের স্কেচ করতে ভাল লাগে। অবসরে তাই ছবি আঁকাতেই মগ্ন থাকে সে।

সৌম্যজিৎদের সঙ্গে মেধাতালিকায় এক সারিতে থাকা বাঁকুড়া জেলা স্কুলের ছাত্র অর্ঘ্য পাল বাংলা ছবির নায়ক দেব-এর ফ্যান। দেব এবার পাত্রসায়রে ভোট প্রচারে এসেছিলেন। সেখানে অর্ঘ্যের মামাবাড়ি। দেব আসছে খবর পেয়ে ঝাঁঝাঁ রোদেই মামাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিল সভাস্থলে। দেবের ছবি বের হলে তা কোনও ভাবেই মিস করে না অর্ঘ্য। এ কথা সে নিজেই জানিয়ে দিচ্ছে। দেব ছাড়াও তার আর এক নেশা হল ফেসবুক।

সে জানায়, তার নিজের স্মার্ট ফোন নেই। অগত্যা ভরসা মায়ের মোবাইল ফোন। সেই ফোনেই দেবের সিনেমা ডাউনলোড করে দেখে অর্ঘ্য। ফেসবুকও করে মায়ের ফোন থেকেই। মাধ্যমিকের আগে তাই এ জন্য প্রায়ই মায়ের কাছে বকুনি খেতে হয়েছে তাকে। অর্ঘ্যর মা মনিকাদেবী বলছেন, “এখন দিনকাল তো ভাল নয়। মোবাইল হাতে পেয়ে কত পড়ুয়ার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আমার ছেলেরও ওই মোবাইলের নেশা। পরীক্ষার আগে মোবাইলে হাত দিলে তাই ওকে খুব বকতাম। তবে তাতেও ওকে আটকানো যেত না।”

বিদ্যাসাগর ভবনে মেধা তালিকা ঘোষণার সময় অর্ঘ্যর নাম শুনেই চমকে গিয়েছিলেন মনিকাদেবী। আর অর্ঘ্যর কথায়, “পড়াশোনার চাপ যতই থাকুক, ফেসবুক করা ও দেবের ছবি দেখার জন্য আমি সময় বের করে নিতাম। তাতে আমার পড়াশোনার কোনও ক্ষতি হয়নি।”

বাঁকুড়ার জয়পুরের হেতিয়া হাইস্কুলের ছাত্র পরিচয় ভট্টাচার্য এক কথায় ‘ক্রিকেট পাগল’। পাড়ার ক্লাবের অন্যতম সদস্য সে। প্রতিদিন নিয়ম করে গ্রামের মাঠেই ক্রিকেট খেলে। ক্লাবের টিমের একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানও বটে। বিরাট কোহলি তার প্রিয় ক্রিকেটার। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকেই টি-২০ বিশ্বকাপ ও আইপিএল চুটিয়ে দেখছে সে। অর্ঘ্যর মতোই পরিচয়ও পড়ে ডাক্তার হতে চায়।

ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহের অন্ধ ভক্ত খাতড়ার রবীন্দ্রসরণির নীলাঞ্জন পাত্র। হাসিখুশি রোগাটে চেহারার ছেলেটি এ বার মাধ্যমিকে ৬৭৫ নম্বর পেয়ে নবম স্থানে রয়েছে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অবসর সময়ে রবীন্দ্রনাথের বই পড়া আর আইপিএল দেখা তার নেশা। যুবরাজ যে দলে নীলাঞ্জনও সেই দলের সমর্থক এ বার আইপিএলে। নীলাঞ্জনের কথায়, ‘‘যুবরাজের ব্যাটিং দেখে মন মোহিত হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই আমি ওর ভক্ত।’’ সময় পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে ব্যাট বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে যুবরাজের এই ভক্ত। তবে এ দিন নিজের ফল দেখে নিজেই তাজ্জব হয়ে গিয়েছে। তার কথায়, ‘‘ভাল ফল করব জানতাম। তা বলে এত ভাল! অবিশ্বাস্য লাগছে।’’ সেও জানিয়েছে, ডাক্তার হতে চায়।

৬৭৪ নম্বর পেয়ে দশম স্থানে রয়েছে পুরুলিয়া জেলা স্কুলের সোহম মজুমদার ও বাঁকুড়া জেলা স্কুলের ছাত্র অর্ণব কুণ্ডু। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর ভক্ত সোহম জানিয়েছে, তার ইচ্ছে ভবিষ্যতে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে গবেষণা করবে। ক্রিকেটের নেশা অর্ণব কুণ্ডুর। বাঁকুড়া জেলা দলের হয়েও খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে অর্ণবের। স্পিন বোলার হিসেবে খুদে ক্রিকেটারদের মধ্যে বেশ সুখ্যাতি রয়েছে তার।

অর্ণব জানায়, পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজের বাড়ির ফাঁকা জায়গাতেই স্পিন বোলিং প্র্যাকটিসও চলত। প্রায় দিন বিকেলেই দল বেঁধে জেলা স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলতেও যায় অর্ণব। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তার প্রিয় ক্রিকেটার। আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্স তার প্রিয় দল। তার কথায়, “একঘেয়েমি কাটাতে খেলাধুলার জুড়ি নেই।”

আফশোস কিছুতেই যাচ্ছে না পুরুলিয়া শহরের গর্ভমেন্ট গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী সায়নী বিশ্বাসের। ৬৭০ নম্বর পাওয়া সায়নী মনে করে, বাংলা ও ইংরেজিতে প্রত্যাশামাফিক নম্বর পেলে মাধ্যমিকে রাজ্যর প্রথম দশে তার নামও উঠে যেত। সেই এ দিন রাত পর্যন্ত পাওয়া খবরে পুরুলিয়া জেলায় মেয়েদের মধ্যে সম্ভাব্য প্রথম।

কিন্তু কৃতিদের স্বপ্ন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের বাইরে কেন বেরোচ্ছে না, সে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। তাঁদের মতে, রাজনীতি থেকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মেধাবিদের প্রয়োজন। কারণ মেধাই যে কোনও পেশাকে অন্য উৎকর্ষে পৌঁছে দিতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Madhyamik Exam Topper TV
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE