বিচারের অপেক্ষায়। মৃণালবাবুর মা দুলালিদেবী এবং স্ত্রী শম্পাদেবী। —নিজস্ব চিত্র
• ৩০ অগস্ট ২০১২-র ভোর। দুবরাজপুরের বাড়ি থেকে ট্রেন ধরতে বেরিয়েছিলেন পেশায় ব্যবসায়ী মৃণালকান্তি ওঝা (৪৫)।
• মোটরবাইক চালাচ্ছিলেন ভাই চম্পক, পিছনে টাকা ভর্তি অ্যাটাচি নিয়ে বসেছিলেন মৃণালবাবু। মাঝে বসেছিল কর্মী লাল্টু নায়ক।
• পথে বাঁশ দিয়ে মোটরবাইক আটকায় তিন দুষ্কৃতী। ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে টাকার অ্যাটাচি।
• বাধা পেতেই মৃণালবাবুর মাথায় গুলি চালিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা। গুলি খান চম্পকবাবুও। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চলছে এখনও।
কলকাতা যাওয়ার ট্রেনটা ছিল ভোর পাঁচটা পাঁচে। বাড়ি থেকে বের হতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। ভাইকে তাই মোটরবাইকের গতি বাড়িয়ে দ্রুত স্টেশনে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। সঙ্গে নিয়েছিলেন দোকানের বিশ্বস্ত কর্মীটিকেও। পথে বাঁশ হাতে তাঁদের মোটরবাইক আটকে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। তাঁর টাকা ভর্তি অ্যাটাচি কেড়ে নিতে শুরু হয় ধস্তাধস্তি। অ্যাটাচি না ছাড়ায় সটান ব্যবসায়ীর মাথা লক্ষ করে গুলি চালিয়ে দিয়েছিল ওই দুষ্কৃতীরা। মুহূর্তে নিথর হয়ে যান পেশায় ব্যবসায়ী মৃণালকান্তি ওঝার (৪৫) শরীর। দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে গুরুতর জখম হন তাঁর ভাইও।
বছর চারেক আগে ২০১২ সালের ৩০ অগস্ট বৃহস্পতিবার দুবরাজপুর ব্লক অফিসের কাছে ঘটে যাওয়া ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছিল শহরবাসীকে। তার স্মৃতি এখনও দগদগে ওই ব্যবসায়ীর পরিবারের কাছে। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পরে এখন সুস্থ হলেও সে দিনের কথা মনে পড়লে আজও চমকে ওঠেন মৃণালবাবুর ভাই চম্পক ওঝা। ওই ঘটনায় প্রথম কয়েক মাস পুলিশ কোনও ‘ক্লু’ খুঁজে পায়নি। পরে সে দিনের ঘটনায় অলৌকিক ভাবে একটুও চোট না পেয়ে সেই ‘বিশ্বস্ত’ কর্মীকে জেরা করেই মামলার তদন্তে মুশকিল আসান করে পুলিশ। বর্তমানে বিচারপ্রক্রিয়া শেষের মুখে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, পেশায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসায়ী দুবরাজপুরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মৃণালবাবু ওরফে রামুর সে দিন ভোরে ব্যবসার সূত্রে কলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল। চম্পকবাবু মোটরবাইকে করে দাদাকে দুবরাজপুর স্টেশনে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। প্রায় দু’ লক্ষ টাকা ভর্তি অ্যাটাচি নিয়ে একেবারে পিছনে বসেছিলেন মৃণাল। আর মাঝে ছিলেন মৃণালবাবুর দোকানের কর্মী লাল্টু নায়ক। বাড়ি থেকে দু’-তিনশো মিটার এগোতেই লক্ষ্মীসায়ের নামে একটি পুকুরের কাছে রাস্তায় তিন দুষ্কৃতী এক টুকরো বাঁশ দিয়ে তাঁদের পথ আটকায়। মোটরবাইক থেকে সকলে নেমে পড়লে টাকা ভর্তি অ্যাটাচি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা। সহজে টাকা দিতে চাননি মৃণালবাবু। সেই সময় একটি বোমা ফাটায় দুষ্কৃতীরা। তখনই নাকি ভয় পেয়ে লাল্টু ছুটে পালিয়ে যান। আর তার পরেই বাধা পেয়ে মৃণালবাবুর মাথায় গুলি করে এক দুষ্কৃতী। মারা যাওয়ার আগেই ভাইয়ের দিকে অ্যাটাচি ছুড়ে দিয়েছিলেন দাদা। তখন দুষ্কৃতীরা চম্পকবাবুকে আক্রমণ করে। পেটে ও শরীরের নানা জায়গায় মোট তিনটে গুলি করে অ্যাটাচি নিয়ে চম্পট দেয়।
ব্যবসায়ী খুনের ঘটনায় এলাকা তোলপাড় হয়ে যাওয়ায় তদন্তে সে দিন একে একে দুবরাজপুরে ছুটে এসেছিলেন পুলিশের কর্তারা। তৎকালীন পুলিশ সুপার হৃষিকেশ মিনা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেবস্মিতা দাস এবং পরে এসেছিলেন তৎকালীন ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) বাসব তালুকদারও। রাতারাতি বদলি করে দেওয়া হয় দুবরাজপুর থানার তৎকালীন ওসি সৌম্য দত্তকে। দায়িত্ব দেওয়া হয় অর্ণব গুহকে। কিন্তু বিস্তর চেষ্টা করেও ঘটনার তিন মাস পরেও কে বা কারা ঘটনায় জড়িত, তার সন্ধান করতে পারছিল না দুবরাজপুর থানার পুলিশ। এ দিকে, ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্ন ওঠে। খুনের কিনারা চেয়ে শহরবাসী পুলিশের উপরে ক্রমাগত চাপও বাড়াচ্ছিলেন।
তদন্তে নেমে কাজে আসে পুলিশের মনে থাকা একটি খটকা। সেটা হল, ঘটনায় তিন জনের মধ্যে এক জন মারা গিয়েছেন। এক জন মারাত্মক জখম হয়েছেন। কী ভাবে গায়ে আঁচড়টি না লাগিয়ে ছুটে পালালেন দোকানের কর্মী লাল্টু? সেই সূত্র ধরেই অবশেষে সাফল্য মেলে। মোবাইলের কল লিস্ট দেখে ওই বছরই ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখ পুলিশ গ্রেফতার করে লাল্টু ও পাড়ুই থানা এলাকার বাসিন্দা উত্তম সাহা নামে এক যুবককে। ধৃতদের জেরা করে এর পরে সিউড়ি থেকে দুলাল দলুই, শিবনাথ তুড়ি এবং অনুভব মণ্ডল নামে আরও তিন যুবক ধরা পড়ে। পুলিশের দাবি ছিল, মৃণালবাবুর গতিবিধি থেকে অপরাধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা— সবই খুব দক্ষতার সঙ্গে করেছিল লাল্টুই। বাকিরা অপারেশন চালিয়েছিল। চম্পক তত দিনে কিছুটা সুস্থ হয়ে সিউড়ি সংশোধনাগারে ধৃত যুবকদের শনাক্তও করেন।
ধৃতেরা জেল হাজতে থাকতে থাকতেই চার্জশিট দেয় পুলিশ। ২০১৩ সাল থেকে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। বর্তমানে মামলাটি সিউড়ি দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা বিচারক মাহানন্দ দাসের এজলাসে বিচারাধীন। জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর রণজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রণজিৎবাবু বলেন, ‘‘ওই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হয়েছে। এ বার ৩১১ নম্বর ধারায় অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বিচারক। তার পরেই মামলার চূড়ান্ত রায় হতে চলেছে।’’
সেই বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন মৃণালবাবুর পরিবার। নিহতের স্ত্রী শম্পা ওঝা, মা দুলালি ওঝারা বলছেন, ‘‘আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যারা এ কাজ করল, তাদের চরমতম শাস্তি চাই।’’ ছেলের দোকানের কর্মী লাল্টু নায়কের উপরে সবচেয়ে বেশি রাগ মা দুলালিদেবী। তিনি বলছেন, ‘‘পাড়ার ছেলেই এমনটা করবে কোনও দিন ভাবিনি। দুধ দিয়ে কাল সাপ পুষেছিলাম আমরা!’’ চোখের সামনে দাদাকে হারানোর দৃশ্যটা মনে পড়লে আজও কেঁপে ওঠেন চম্পকবাবু। দোকানের দেওয়ালে নিহত দাদার ছবির সমানে বসে সে দিনের কথা বলতে গিয়ে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। হতাশা মাখা সুরে বললেন, ‘‘লাল্টুটাকে ভাইয়ের মতো দেখতাম। এমন কাজ এক জন মানুষ করতে পারে? মেনে নিতে পারিনি।’’ আপাতত আদালতের উপরেই আস্থা রাখছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy