Advertisement
১৯ মে ২০২৪

স্বামীকে খুন করাতে প্রেমিককে সুপারি, ধৃত বারিকুলের বধূ

মদ্যপ স্বামীর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে তাঁকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন স্ত্রী। কিন্তু, বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের ওই আদিবাসী বধূ যে ভাবে প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে স্বামীকে খুন করিয়েছেন, তা জেনে তাজ্জব বনে গিয়েছে পুলিশও।

ধৃত বধূ প্রতিমা সরেন।  —নিজস্ব চিত্র

ধৃত বধূ প্রতিমা সরেন। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বারিকুল শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৬ ০২:২৭
Share: Save:

মদ্যপ স্বামীর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে তাঁকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন স্ত্রী। কিন্তু, বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের ওই আদিবাসী বধূ যে ভাবে প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে স্বামীকে খুন করিয়েছেন, তা জেনে তাজ্জব বনে গিয়েছে পুলিশও। শুধু তাই নয়, পুলিশের দাবি, পরিকল্পনা সফল করার জন্য প্রেমিকের হাতে নগদ ৮০ হাজার টাকাও তুলে দিয়েছিলেন ওই বধূ!

সত্যি কথা বললে রাজসাক্ষী বানিয়ে বাঁচিয়ে দেওয়া হবে, এই টোপ গিলেই গড়গড় করে গোটা ষড়যন্ত্র তাঁদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছেন বাঁকুড়ার বারিকুল থানার ছেন্দাপাথর গ্রামের বাসিন্দা প্রতিমা সরেন—এমনটাই দাবি তদন্তকারীদের।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বারিকুল থানার গোয়ালমুড়ির জঙ্গল সংলগ্ন ধানজমিতে উদ্ধার হয়েছিল প্রতিমার স্বামী কাশীনাথ সরেনের (৩০) দেহ। স্থানীয় মাজগেড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা কাশীনাথের পরিচয় জানতেই পুলিশের লেগে গিয়েছিল দু’দিন। তদন্ত করে কাশীনাথকে খুনের অভিযোগে ধাপে ধাপে স্ত্রী প্রতিমা, তাঁর প্রেমিক বারিকুল লাগোয়া পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ির কেঁউদিশোলের বাসিন্দা নীলেশ সর্দার, সুশনিজোবির বিকাশ মুর্মু এবং বারিকুলের সাতনালার বিষ্ণুপুদ পাল ও অরলো এলাকার বাসিন্দা গুরুপদ সর্দারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, “তদন্তকারী আধিকারিকেরা সাফল্যের সঙ্গে দ্রুত দোষীদের ধরেছেন। ঘটনায় আরও কেউ জড়িত কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

পুলিশ জানিয়েছে, বিয়ের পর থেকে কাশীনাথ শ্বশুরবাড়ি ছেন্দাপাথরেই থাকতেন। প্রতিমা গ্রামেই নিজের বাবার রেশন দোকান চালান। ১৫ সেপ্টেম্বর শ্বশুরবাড়ি থেকেই নিখোঁজ হন কাশীনাথ। দু’দিন ধরে স্বামী নিখোঁজ থাকলেও কেন পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেননি, তা নিয়ে পুলিশের প্রশ্নের মুখে পড়েন প্রতিমা। তাঁর রেশন দোকানের কর্মী বিষ্ণুপদকে জেরা করে পুলিশ জানতে পারে, নীলেশের নিয়মিত যাতায়াত ছিল প্রতিমার বাড়িতে। এর পরেই প্রতিমাকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন খোদ এসডিপিও (খাতড়া) ঈশানী পাল। ঝিলিমিলি ফাঁড়ির ইনচার্জ প্রসেনজিৎ দাসকে ঘটনার তদন্তকারী আধিকারিকের দায়িত্ব দিয়ে তদন্ত পরিচালনা করছিলেন বারিকুল থানার আইসি দেবাশিস পান্ডা।

পুলিশের দাবি, জেরার মুখে এক সময় ভেঙে পড়ে বিষ্ণুপদই প্রথম খুনের কথা কবুল করে। তখন প্রতিমাকে রাজসাক্ষী করার টোপ দেয় পুলিশ। সাজা মুকুবের আশায় তিনি সব জানিয়ে দেন। পুলিশের দাবি, জেরায় প্রতিমা জানান, দিনের পর দিন মদ খেয়ে কাশীনাথ অত্যাচার চালাতেন তাঁর উপরে। স্বামীর প্রতি ক্ষোভ থেকেই নীলেশের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু, তার জন্য কাশীনাথকে সরানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। নীলেশকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ভাড়াটে খুনি জোগাড় করতে বলেন প্রতিমা। নীলেশ অবশ্য ৫০ হাজার টাকায় ভাড়াটে খুনিদের সঙ্গে রফা করে ৩০ হাজার টাকা নিজে আত্মসাৎ করার ফন্দি এঁটেছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

পুলিশের দাবি, নীলেশ এই কাজের জন্য সঙ্গে নেয় বিকাশ, গুরুপদ ও বিষ্ণুপদকে। অগ্রিম বাবদ তাঁদের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়। আরও এক জন এই ঘটনায় জড়িত বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। তবে, তদন্তের স্বার্থে তারা নাম জানাচ্ছে না। পরিকল্পনা মাফিক ১৫ সেপ্টেম্বর কাশীনাথকে গোয়ালমুড়ির জঙ্গলে পিয়াল কাঠ কাটতে যাওয়ার নাম করে নিয়ে যান নীলেশ, বিকাশ, গুরুপদরা। কাশীনাথ নিজে কাঠের ব্যবসায়ী ছিলেন। ফলে কাঠ আনতে যাওয়ার কথা সহজেই রাজি হয়ে যান। জঙ্গলে গিয়ে প্রথমে মদ্যপান করেন সকলে। ধৃতদের জেরা করে পুলিশ জেনেছে, মদ্যপানের পরে সুযোগ বুঝে জঙ্গল সংলগ্ন গোয়ালমুড়ি গ্রামের এক বাসিন্দার ধানজমিতে ফেলে পরের পর ভোজালির কোপ মেরে খুন করা হয় কাশীনাথকে। খুনিদের সঙ্গে দিশি রিভলভারও ছিল। সেটি জঙ্গলেই বস্তাবন্দি করে লুকিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ সব অস্ত্রই উদ্ধার করেছে।

স্থানীয় সূত্রের খবর, বেলপাহাড়ির ওই এলাকায় নীলেশ ও বিকাশের বিরুদ্ধে নানা দুষ্কর্মের অভিযোগ রয়েছে। নীলেশের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় চুরির মামলাও আছে। খুনের অভিযোগে আপাতত বিষ্ণুপদ ও প্রতিমা জেল হেফাজতে রয়েছেন। নীলেশকে গ্রেফতার করার পরে পাঁচ দিনের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে পুলিশ গুরুপদ ও বিকাশকে পাকড়াও করে।

সোমবার তাঁদের খাতড়া আদালতে তোলা হলে ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার নীলেশকে ফের আদালতে তোলার কথা।

প্রতিমা ও কাশীনাথের বছর চারেকের একটি সন্তান রয়েছে। আপাতত সে প্রতিমার বাপের বাড়িতেই রয়েছে। কাশীনাথের দাদা তারাপদ সরেনের আক্ষেপ, “ভাই পরিবার নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকত। ভাবতেই পারছি না, প্রতিমা এমন ঘটনা ঘটাতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

woman Arrested Plan to murder husband
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE