Advertisement
E-Paper

অধরা মুস্তফা, পুলিশকেই দুষছে পরিবার

শাসক দলের শীর্ষ নেতার হুঙ্কারে এক দিকে, উদ্বুদ্ধ দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকেরা। উল্টো দিকে তখন ঘাম ছুটেছে পুলিশের বড় কর্তাদের! পঞ্চায়েত ভোটের সময় প্রকাশ্য মঞ্চে ‘বিক্ষুব্ধ’দের বাড়িতে বোমা মারার পরামর্শ দিতে দেখা গিয়েছিল খোদ দলেরই ওই শীর্ষ নেতাকে।

মহেন্দ্র জেনা

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৪ ০০:২১
বোমায় ভেঙেছে বাড়ির চাল। সেটাই দেখাচ্ছেন বধূ। ছবি: বিশ্বজিত্‌ রায়চোধুরী।

বোমায় ভেঙেছে বাড়ির চাল। সেটাই দেখাচ্ছেন বধূ। ছবি: বিশ্বজিত্‌ রায়চোধুরী।

শাসক দলের শীর্ষ নেতার হুঙ্কারে এক দিকে, উদ্বুদ্ধ দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকেরা। উল্টো দিকে তখন ঘাম ছুটেছে পুলিশের বড় কর্তাদের!

পঞ্চায়েত ভোটের সময় প্রকাশ্য মঞ্চে ‘বিক্ষুব্ধ’দের বাড়িতে বোমা মারার পরামর্শ দিতে দেখা গিয়েছিল খোদ দলেরই ওই শীর্ষ নেতাকে। বিরোধীদের অভিযোগ, কার্যত তারপর থেকেই শাসক দলের কর্মী এবং পুলিশ মহলে এমন প্রতিক্রিয়াই দেখা গিয়েছে। তাদের আরও দাবি, নেতার সে দিনের ওই পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন দলের নিচুতলার নেতা-কর্মীরা। তার জেরেই পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে নির্দল প্রার্থীদের বাড়িতে যে হামলা শুরু হয়েছিল, তা আজও অব্যাহত। সাগর ঘোষ থেকে রহিম শেখ বিরোধীদের উপরে হামলার সেই ট্রাডিশনই চলছে। বিরোধীরা বলছেন, মঙ্গলবার রাত এবং বৃহস্পতিবার সকালে পাড়ুইয়ের সাত্তোর পঞ্চায়েতের ভেড়ামারি গ্রামে ‘বিক্ষুব্ধ’ তৃণমূল কর্মীদের উপরে হামলা, তারই একটি সংযোজন মাত্র।

ঘটনা হল, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই নাম জড়িয়েছে তৃণমূলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর। তারা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অন্য দিকে, বিরোধী থেকে নিহতদের পরিজন, সবার দাবি, কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেনি। তাই সাগরবাবুর খুনে অভিযুক্ত তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী কিংবা রহিম শেখ খুনে অভিযুক্ত দলের ইলামবাজার ব্লক সভাপতি জাফারুল ইসলাম কাউকেই পুলিশ গ্রেফতার করার সাহস দেখায়নি। এমনকী, ভেড়ামারিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দু’বার হামলা হলেও কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশ অপরাধমূলক কার্যকলাপ রুখতে পারেনি। উল্টে, বৃহস্পতিবার সকালে হামলার বেশ কিছু ক্ষণ পরে গ্রামে পুলিশের যে বাহিনী পৌঁছয়, তাদের বিরুদ্ধেই নিরীহ গ্রামবাসীদের বাড়িতে ঢুকে হামলার অভিযোগ উঠেছে। জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া অবশ্য কোনও অভিযোগই মানতে চাননি।

“আমার স্বামীর উপরে যারা হামলা চালিয়েছে, তারা এখনও বুক ফুলিয়ে ঘুরছে।
থানায় অভিযোগ করলেও পুলিশ তাদের কাউকেই গ্রেফতার করছে না।”

রোশেনা বিবি, আক্রান্ত বাবু শেখের স্ত্রী।

মঙ্গলবারের হামলায় বোমার আঘাতে গুরুতর জখম বাবু শেখকে বুধবারই কলকাতার পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ দিন গ্রামের পূর্বপাড়ায় (মাদ্রাসা পাড়া) নিজের বাড়িতে বসে রীতিমতো আতঙ্কে কাঁপছিলেন তাঁর স্ত্রী রোশেনা বিবি। কিছু ক্ষণ আগেই দুষ্কৃতীরা গ্রামেরই তিন বাসিন্দার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। কোনও রকমে বললেন, “আমার স্বামীর উপরে যারা হামলা করেছিল, তারা এখনও বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। থানায় অভিযোগ করলেও পুলিশ তাদের কাউকেই গ্রেফতার করছে না।” বিশেষ কোনও চাপেই পুলিশ এমনটা করছে বলে তাঁর দাবি। অন্য দিকে, একই গ্রামের রোশেনা বিবিরা এলাকায় বরাবরই তৃণমূল পরিবার বলে পরিচিত। কয়েক বছর আগেই তিনি প্রথম স্বামী মহসিন শেখকে হারিয়েছেন। অভিযোগ, তৃণমূল করার অপরাধে সিপিএমের দুষ্কৃতীরা তাঁকে খুন করেছিল। পরে মহসিনেরই ভাই বাবু শেখকে বিয়ে করেছিলেন রোশেনা। এ দিন তাঁর ক্ষোভ, “সিপিএমের কেউ নয়, আমার নিজের দলের লোকেরাই এ বার দ্বিতীয় স্বামীকে খুনের চেষ্টা করল। তাঁর অপরাধ, পঞ্চায়েতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়েছিলেন।”

দলীয় সূত্রে খবর, এক সময় এই বাবু শেখেরই উপরে ভর করে ভেড়ামারি, সালোন-সহ সাত্তোর পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকায় বামেদের পরাস্ত করে নিজের দখল কায়েম করেছিল তৃণমূল। গত পঞ্চায়েত ভোটে সেখানে দলেরই ‘বিক্ষুব্ধ’ তথা নির্দল প্রার্থীদের রমরমা শুরু হয়। পঞ্চায়েত ভোটের পরে বাবু তাঁদের দিকেই ঝুঁকে পড়েন। অভিযোগ, তারপর থেকেই তিনি অনুব্রত অনুগামী শেখ মুস্তফা এবং দুলাল শেখদের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। সম্প্রতি পঞ্চায়েতের বেশ কিছু কাজ নিয়ে ‘প্রতিবাদ’ করায় তাঁর উপরে হামলা চালানো হল বলে দাবি। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূলের সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফা বলেন, “ওরা দলের কেউ নয় প্রত্যেকেই সমাজবিরোধী। নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোল থেকেই এই সব হচ্ছে।” তাঁর সেই ব্যাখ্যা অবশ্য ভিত্তিহীন বলেই দাবি করেছেন পাড়ুইয়ের ‘বিক্ষুব্ধ’ তৃণমূল নেতা নিমাই দাস। তাঁর পাল্টা দাবি, “দলেরই একটি বিশেষ গোষ্ঠী কোনও বিরোধী সুর শুনতে নারাজ। ওরা সন্ত্রাস করে সেই সব প্রতিবাদী মুখ বন্ধ করতে চাইছে।” গত দু’দিনের এই হামলা তারই সূত্রে বলে নিমাইবাবুর অভিযোগ।

নিমাইবাবুদের সুরেই সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, গোটা জেলাতেই শাসক দল সন্ত্রাস কায়েম করেছে। তিনি বলেন, “এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়। বিরোধী থেকে সাধারণ মানুষ, সবার জনজীবন বিপর্যস্ত করাই ওদের কাজ। আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব না। নিরাপত্তার দাবিতে শীঘ্রই পুলিশ-প্রশাসনের কাছে আর্জি জানাব।” প্রতিবাদে নামছে বিজেপিও। হামলার তীব্র নিন্দা করে বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল বলেন, “গোটা রাজ্য জুড়েই শাসক দল সন্ত্রাস কায়েম করেছে। দলের কর্মীদেরও ওরা ছাড় দিচ্ছে না। মানুষ থানায় গিয়ে অভিযোগ জমা দিতেও ভয় পাচ্ছেন।” এই পরিস্থিতিতে আগামী ১৬ জুলাই বোলপুরে সন্ত্রাস বিরোধী জনসভার ডাক দিয়েছে বিজেপি। দলীয় সূত্রের খবর, সেখানে আসানসোলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়, রাহুল সিংহ-সহ রাজ্য নেতৃত্বের অনেকেই যোগ দেবেন। দুধকুমারবাবু জানান, শাসক দলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানুষকে একজোট করে ওই সভা থেকেই একটি প্রতিরোধ মঞ্চ গড়ে তোলা হবে।

mustafa mahendra jena parui
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy