Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কোন পথে রেল, প্রশ্নে দীর্ণ বাস নিয়ে নাকাল মানবাজার

রেলপথ এখনও স্বপ্নই। দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানো সত্ত্বেও এখনও মানবাজার রেল মানচিত্রে আসেনি। কবে রেলপথ জুড়বে এই শহরকে তারও নিশ্চয়তা নেই। এ দিকে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থাও তথৈবচ। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়লেও মানবাজার ও পুরুলিয়ার সড়ক পথে পরিবহণ ব্যবস্থা এখনও সেই সাবেক আমলেই আটকে রয়েছে।

সমীর দত্ত
মানবাজার শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৫২
Share: Save:

রেলপথ এখনও স্বপ্নই। দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানো সত্ত্বেও এখনও মানবাজার রেল মানচিত্রে আসেনি। কবে রেলপথ জুড়বে এই শহরকে তারও নিশ্চয়তা নেই। এ দিকে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থাও তথৈবচ। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়লেও মানবাজার ও পুরুলিয়ার সড়ক পথে পরিবহণ ব্যবস্থা এখনও সেই সাবেক আমলেই আটকে রয়েছে।

ঝাড়গ্রাম থেকে রেলপথ দক্ষিণ পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা ছুঁয়ে আদ্রা পর্যন্ত নিয়ে আসার দাবিতে পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামের মানুষজন অনেক দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। আন্দোলনও কম হয়নি। কিন্তু আজও ওই রেলপথ বাস্তবায়িত হয়নি। ওই রেলপথ আদৌ করা হবে কি না, তা নিয়েও রেলমন্ত্রকের সুনিশ্চিত মত পাওয়া যায়নি বলে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ। ফলে শুধু মানবাজারই নয়, পুরুলিয়া জেলার দক্ষিণ অংশের কয়েক হাজার গ্রামের বাসিন্দার ভরসা রুটের কয়েকটি মাত্র বেসরকারি বাস।

এ দিকে, মানবাজার শহর ক্রমশ আড়েবহরে বেড়েই চলেছে। জনবসতি, জনসংখ্যা বেড়ে চললেও পরিবহণ ব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় সমস্যা বাড়ছে। বাসিন্দারা জানান, মানবাজার থেকে ভোর পৌনে ৫টায় পুরুলিয়ার প্রথম বাস ছাড়ে আর শেষ বাস রওনা দেয় সাড়ে ৫টায়। ব্যাস! তারপর আর পুরুলিয়ায় যাওয়ার গণপরিবহণের কোনও ব্যবস্থা নেই। পরের দিন ভোর পর্যন্ত বাসের অপেক্ষায় থাকতে হয়। উপরি হিসেবে, রবিবার পুরুলিয়া থেকে বিকেল ৪টের পরে মানবাজারের বাস থাকে না।

অথচ, রেল চালু হলে এই এলাকার ভোল বদলে যেত। রেল সূত্রে জানা যায়, ঝাড়গ্রাম-পুরুলিয়া এবং ঝাড়গ্রাম-আদ্রা দু’টি রেলপথের প্রস্তাব রেলমন্ত্রকের কাছে জমা পড়েছিল। দীর্ঘদিন রেল বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বাসুদেব আচারিয়া। তিনি জানান, রামবিলাস পাশোয়ান রেলমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৯৭ সালে প্রথম সমীক্ষা করা হয় ঝাড়গ্রাম-পুরুলিয়া ভায়া টামনা রেলপথের। এই লাইন মানবাজার ১, ২ ব্লকও ছুঁয়ে যেত। সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল, ওই রুটে ট্রেন চালানো খুব একটা অলাভজনক নয়। আবার বিরাট লাভজনকও ছিল না। কিন্তু ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা থেকে কয়লা ও লৌহ আকরিক পরিবহণের ক্ষেত্রে ওই লাইনটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত। তাঁর আক্ষেপ, “রামবিলাস মন্ত্রীত্ব থেকে সরে যাওয়ার পরে বিষয়টি আটকে যায়। পরে লালুপ্রসাদ রেলমন্ত্রী হয়ে বাজেটে জানান, সমীক্ষার ফল রেলবোর্ড প্ল্যানিং কমিশনে পাঠিয়েছে। তাদের অনুমতি পেলে কাজ এগোবে। কিন্তু ওই প্রকল্পের কাজ আর এগোয়নি। ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে।”

অন্য দিকে, ঝাড়গ্রাম থেকে আদ্রা রেলপথ নিয়েও কম আন্দোলন হয়নি। মানবাজারের বাসিন্দা তথা আদ্রা-ঝাড়গ্রাম রেল সংগ্রাম সমিতির আহ্বায়ক আনন্দময় সেন জানান, তাঁরা কয়েক দশক ধরে ওই রেলপথের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। লালুপ্রসাদ যাদব, রামবিলাস পাশোয়ান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁদের কাছে আবেদনও জানানো হয়েছে। কয়েক লক্ষ বাসিন্দার স্বাক্ষরিত চিঠি রেলমন্ত্রকে পাঠানো হয়েছে। সভা, পদযাত্রাও কম হয়নি। তিনি বলেন, “এত কিছুর পরেও ওই রেলপথের ভবিষ্যত্‌ কী, রেলমন্ত্রকই বা কী ভাবছে কিছুই আমরা জানতে পারছি না। সম্প্রতি শুনছি ঝাড়গ্রাম থেকে একটি রেলপথ বান্দোয়ান ছুঁয়ে চান্ডিলে নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের প্রশ্ন, দক্ষিণ পুরুলিয়ার এই বৃহত্‌ অংশকে এ ভাবে কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে। কোন যুক্তিতে রেলপথ চান্ডিলে মেশানো হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।” নরেন্দ্র মোদী লোকসভা নির্বাচনের আগে বাঁকুড়ায় সভা করতে এলে এই সংগঠন থেকে তাঁর কাছেও ওই রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। একই দাবিতে কয়েক বছর আগে জেলা কংগ্রেস বান্দোয়ান থেকে মানবাজার ছুেঁয় আদ্রা পর্যন্ত পদযাত্রা করেছিল। কিন্তু ওই রেলপথ এরপরেও আদৌ বাস্তবের মুখ দেখবে কি না তা নিয়ে ঘোর সংশয় তৈরি হয়েছে।

পুরুলিয়া জেলার ২০টি ব্লকের মধ্যে অর্ধেক ব্লকেই রেলপথ নেই। তবে বাস ছাড়াও ওই সব রুটে ছোট ভাড়ার গাড়ি চলে। কিন্তু মানবাজার থেকে পুরুলিয়ায় ছোট ভাড়ার গাড়িও চলে না। ফলে বাসের বিকল্প কিছু তৈরি হয়নি। নেই সরকারি বাসও। অগত্যা, খুব প্রয়োজন পড়লে মোট টাকা খসিয়ে গাড়ি ভাড়া করে পুরুলিয়ায় যাতায়াত করতে হয়।

বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, মানবাজার থেকে ভোরে প্রথম গাড়ি বেড়িয়ে পুরুলিয়া শহরে ঢুকতে ৭টা বেজে যায়। আবার রাস্তায় গাড়ি বিগড়োলে অনেক সময় ওই ৫৪ কিলোমিটার পথ যেতেও সকাল ৮টা কিংবা ৯টা বেজে যায়। মাঝে মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে মানবাজারবাসীর। তার উপরে বাসে আরও যাত্রী তোলার জন্য মানবাজারের ইন্দকুড়ি মোড়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থাকে। বিনয় চক্রবর্তী, শঙ্কনিনাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নিত্যযাত্রীদের আক্ষেপ, “কত জায়গায় ১০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে নিত্যযাত্রীরা বাড়ি থেকে অফিস-কাছারি করছেন। কিন্তু আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য না হল রেলপথ, না উন্নতি হল সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থার। ফলে আগে বেড়িয়েও ঠিক সময়ে পুরুলিয়ায় পৌঁছতে পারব কি না তা নিয়ে অশ্চিয়তায় থাকতে হয়।”

মানবাজারের বাসিন্দা গৌতম দত্ত জানান, বাস ছাড়ার সময় নিয়ে গোলমাল থাকায় সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন তিনি পুরুলিয়ায় থেকে যান। এ জন্য তাঁকে পুরুলিয়া শহরে ঘরভাড়া নিতে হয়েছে। আসা-যাওয়ায় প্রতিদিন সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা যাতায়াতের ধকল নিতে পারছেন না। এ দিকে ওই রুটে দ্রুতগামী এক্সপ্রেস বাস মাঝে মধ্যে চালু করা হলেও আবার হঠাত্‌ করেই বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। যদিও তা মানতে চাননি পুরুলিয়া বাস মালিক সমিতির সম্পাদক প্রতিভারঞ্জন সেনগুপ্ত। তাঁর দাবি, “ওই রুটে কয়েকটি এক্সপ্রেস বাস চালু রয়েছে। বিকেলের পরে ওই রুটে যাত্রী কম থাকে বলে বাস চালানো হয় না।”

তিনি জানান, আঞ্চলিক পরিবহণ দফতর মানবাজার ও পুরুলিয়ার মধ্যে বাসের সময়সীমা ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট বেঁধে দিলেও কিছু সমস্যার জন্য বাড়তি ২০ মিনিট সময় নেয় বাসচালকরা। তবে যে সব বাস ২ ঘণ্টার বেশি সময় নেয়, সেই বাসমালিকদের সঙ্গে তিনি এ নিয়ে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে মানবাজারে একটি মেলায় এসেছিলেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। তিনি মঞ্চেই ঘোষণা করেছিলেন এই রুটে সারাদিনে অন্তত দু’টি সরকারি বাস যাতে চালানো যায়, তিনি সে ব্যবস্থা করবেন। স্থানীয় নেতাদের এই বিষয় নিয়ে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে জানিয়ে গিয়েছিলেন। বাসিন্দাদের আক্ষেপ মন্ত্রীর ঘোষণাই সার। কোনও সরকারি বাস এই রাস্তায় চলেনি। কেন? জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ কমিটির সদস্য। তাঁর কথায়, “সরকারি বাসের সংখ্যা কম। দফতর থেকে নতুন বাস পাওয়া গেলে মানবাজার রুটে চালানো হবে।”

আন্দোলন, আক্ষেপ আর আশ্বাস এ সব নিয়েই মানবাজারের বাসিন্দারা পরিবহণ ব্যবস্থার হাল পরিবর্তনের এমন স্বপ্ন দেখছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE