Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কুপি উল্টে দগ্ধ কিশোরী পরীক্ষা দিল বার্ন ওয়ার্ডে

পরিবার গরিব, কিন্তু নাম ওঠেনি বিপিএল তালিকায়। তাই স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পাননি। গ্রামের যাঁরা টাকা দিয়ে সংযোগ নিয়েছেন, তাঁদের বিদ্যুতের বিলের অঙ্ক দেখে সংযোগ নিতে সাহস করেননি কেন্দার পেঁচাড়া গ্রামের মহানন্দ মাহাতো। তাঁর মেয়ে সুমিত্রা তাই কুপির আলোতেই মাধ্যমিকের পড়া তৈরি করছিল। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কুপি উল্টে আগুন ধরে বইয়ে, তা থেকে জামায়।

হাসপাতালে পরীক্ষা দিচ্ছে সুমিত্রা মাহাতো। ছবি: প্রদীপ মাহাতো

হাসপাতালে পরীক্ষা দিচ্ছে সুমিত্রা মাহাতো। ছবি: প্রদীপ মাহাতো

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল ও প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৯
Share: Save:

পরিবার গরিব, কিন্তু নাম ওঠেনি বিপিএল তালিকায়। তাই স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পাননি। গ্রামের যাঁরা টাকা দিয়ে সংযোগ নিয়েছেন, তাঁদের বিদ্যুতের বিলের অঙ্ক দেখে সংযোগ নিতে সাহস করেননি কেন্দার পেঁচাড়া গ্রামের মহানন্দ মাহাতো। তাঁর মেয়ে সুমিত্রা তাই কুপির আলোতেই মাধ্যমিকের পড়া তৈরি করছিল। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি কুপি উল্টে আগুন ধরে বইয়ে, তা থেকে জামায়। কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত পুড়ে যাওয়ায় রাতেই পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সুমিত্রাকে।

দুর্ঘটনার মাত্র আট দিনের মাথায় মাধ্যমিক পরীক্ষা। হাসপাতালের চারতলায় বার্ন ওয়ার্ডের বিছানাতে বসে পরীক্ষা দিল সুমিত্রা। “আগুনে পায়ের দিকটা পুড়েছে, হাত তো পোড়েনি,” বলল রাজনোয়াগড় দেবীপ্রসাদ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের মেধাবী এই ছাত্রী। জানাল, বাংলা পরীক্ষা ভালই হয়েছে।

“আমরা প্রথমে চাইনি, মেয়ে এই অবস্থায় হাসপাতাল থেকে পরীক্ষা দিক। কিন্তু সুমিত্রা কোনও মতেই এক বছর নষ্ট করতে চায়নি,” বললেন মহানন্দবাবু। “মেয়ে বারবার বলেছিল, পরীক্ষা দিতে চাই। কিছু একটা ব্যবস্থা করো।” মহানন্দবাবুর আবেদনে সাড়া দিয়ে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সদস্য তথা পুরুলিয়াতে মাধ্যমিক পরীক্ষার পরিচালন সমিতির আহ্বায়ক কামাখ্যাপ্রসাদ ত্রিপাঠী হাসপাতাল থেকেই সুমিত্রার পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। পুঞ্চার বালকডি হাই স্কুলে পরীক্ষার আসন পড়েছে সুমিত্রার স্কুলের পড়ুয়াদের। বালকডি হাই স্কুলেরই এক শিক্ষক হাসপাতালে সুমিত্রার পরীক্ষা তত্ত্বাবধান করছেন।

পুরুলিয়া সদর হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, “মেয়েটির ২৫-৩০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। মাত্র ক’দিন আগে এতখানি পোড়ার পর বিছানায় বসে তিন ঘণ্টার পরীক্ষা দেওয়া খুবই কষ্টকর। অসামান্য মনের জোর না থাকলে এমন সম্ভব নয়।”

সুমিত্রার মতোই গত বছর আগুনকে হারিয়ে মাধ্যমিকে বসেছিল রৌশেনারা খাতুন। হুগলির খানাকুলের কাঁটাপুকুর গ্রামের রৌশেনারা বিয়ে না করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চেয়েছিল। অভিযোগ, সেই জন্য তার সৎ মা, দিদিমা ও বাবা রাতে ঘুমের মধ্যে রৌশেনারার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ৯০ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে চার মাস লড়াই করে রৌশেনারা ফেরে পিসির বাড়িতে। দেহে ক্ষত নিয়েই মাস নয়েক পরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছিল সে। তার আগেই অবশ্য নারী ও সমাজকল্যাণ দফতর সাহসিকতার জন্য পুরস্কার দিয়েছিল রৌশেনারাকে।

কিন্তু জ্বলন্ত কুপির ঝুঁকি থেকে গরিব পড়ুয়ারা মুক্তি পাবে কবে? পেঁচাড়া গ্রামে বিদ্যুৎ এলেও, বিপিএল তালিকায় নাম না-থাকায় বাড়িতে স্বল্প মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগের সুবিধা পায়নি সুমিত্রার পরিবার। মহানন্দবাবুর দাবি, “পাঁচ বছর আগে যখন গ্রামে বিদ্যুৎ আসে, তখন বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়ে আবেদন করেও পাইনি। পরে দেখি, যারা বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছে তাদের যে মাত্রায় বিদ্যুতের বিল আসছে, তা মেটানো অসম্ভব। তাই আর নতুন করে আবেদন জানাইনি।” সুমিত্রার বোন, নবম শ্রেণির মৌসুমী কুপির ভরসাতেই পড়াশোনা চালাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE