Advertisement
E-Paper

কালীপুজোতেও বকেয়া মজুরি এল না শ্রমিকদের

ঘটনা ১। তিনমাস আগে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে পুকুর সংস্কার করার পরে নিতুড়িয়ার বিমান বাউরি, অক্ষয় বাউরিরা ভেবেছিলেন দুর্গাপুজোর আগে মজুরি পেয়ে যাবেন। পেরিয়ে গিয়েছে পুজো, টাকা মেলেনি। মজুরি চেয়ে ভামুরিয়া পঞ্চায়েতে শ্রমিকরা তালাও ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের আশা ছিল এ বার, কালীপুজোর আগে মজুরি মিলবে। কিন্তু তাও হল না। বুধবার ওই শ্রমিকরা আক্ষেপ করছিলেন, “অন্যত্র কাজের সুযোগ নেই। এই প্রকল্পের কাজই ভরসা। দুর্গাপুজোয় হয়নি, ভেবেছিলাম কালীপুজোয় অন্তত পাব। তাও হল না।”

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৪৫

ঘটনা ১। তিনমাস আগে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে পুকুর সংস্কার করার পরে নিতুড়িয়ার বিমান বাউরি, অক্ষয় বাউরিরা ভেবেছিলেন দুর্গাপুজোর আগে মজুরি পেয়ে যাবেন। পেরিয়ে গিয়েছে পুজো, টাকা মেলেনি। মজুরি চেয়ে ভামুরিয়া পঞ্চায়েতে শ্রমিকরা তালাও ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের আশা ছিল এ বার, কালীপুজোর আগে মজুরি মিলবে। কিন্তু তাও হল না। বুধবার ওই শ্রমিকরা আক্ষেপ করছিলেন, “অন্যত্র কাজের সুযোগ নেই। এই প্রকল্পের কাজই ভরসা। দুর্গাপুজোয় হয়নি, ভেবেছিলাম কালীপুজোয় অন্তত পাব। তাও হল না।”

ঘটনা ২। কয়েকদিন আগে একশো দিনের প্রকল্পের বকেয়া মজুরি প্রধানের কাছে এসে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছিলেন শ্রমিকরা। বেকো পঞ্চায়েতের সিপিএমের প্রধান শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, পঞ্চায়েতের তরফে প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বার মজুরি আসবে ডাকঘরে সরাসরি শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে। কিন্তু শ্রমিকদের পাল্টা দাবি, তিনমাস ধরে ঘুরছেন তাঁরা, মজুরি আসেনি। তাই প্রধানকেই ব্যবস্থা করতে হবে। বেকোর প্রধান কাজল ভট্টাচার্যর মন্তব্য, “সারা দিন ধরে এই একশো দিনের প্রকল্পে বকেয়া মজুরির সমস্যাতেই চলে যাচ্ছে। অন্যান্য কাজ শিকেয় উঠেছে।”

ঘটনা ৩। পুজোর আগে বকেয়া মজুরির দাবিতে কর্মীদের ঘেরাও করে রঘুনাথপুর ২ ব্লকের মঙ্গলদা-মৌতোড় পঞ্চায়েতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন শ্রমিকরা। খবর পেয়ে পঞ্চায়েতে যান যুগ্ম বিডিও শমীক ভড়। শ্রমিকদের সমস্যা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু কাজ হয়নি। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যুগ্ম বিডিওকে নিগ্রহ করার অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় ব্লক প্রশাসন তিনজনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে। গ্রেফতারও হয় অভিযুক্তেরা।

তিনটি ঘটনাই একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বকেয়া মজুরি না পাওয়ায় পুরুলিয়া জেলাজুড়ে বিভিন্ন পঞ্চায়েতে চলা অবস্থার উদাহরণ মাত্র। অর্থাত্‌ শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি না হওয়ায় তাঁরা তো সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। এ ছাড়া তাঁদের সময়ে মজুরি দিতে না পারায় জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসনিক আধিকারিকরাও স্বস্তিতে নেই। প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই জেলার ১৭০টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বেশির ভাগ পঞ্চায়েতেই এই সমস্যা চলছে। এ দিকে উত্‌সবের মরসুম চলায় হাতে টাকা না থাকায় ক্ষোভ বাড়ছে শ্রমিকদের মধ্যে।

কেন এই অবস্থা? পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ব্লক প্রশাসন এমনকী একশো দিনের কাজের প্রকল্পের সাথে যুক্ত থাকা জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের বক্তব্য, মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনলাইন পদ্ধতি শুরু করার পরেই জটিলতা তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে পঞ্চায়েতে শ্রমিকদের মজুরি ডাকঘরের মাধ্যমে দেওয়া হয়, তাঁরাই সমস্যায় পড়ছেন। রঘুনাথপুর ১ ব্লকের এক আধিকারিক জানান, তাঁর এলাকার চোরপাহাড়ি পঞ্চায়েতে শ্রমিকদের অ্যাকাউন্ট রয়েছে স্থানীয় উপ-ডাকঘরে। চোরপাহাড়িতে মজুরি বাবদ বকেয়া পুরো টাকাই আটকে রয়েছে। আবার নতুনডি পঞ্চায়েতের অধিকাংশ শ্রমিক মজুরি পান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের স্থানীয় শাখায়। এই পঞ্চায়েতে বকেয়া মজুরির ৭০ শতাংশ মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বস্তুত আগস্ট মাস থেকেই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী দুর্নীতি এড়াতে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ডাকঘর ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সরাসরি শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে মজুরি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখানেই বেঁধেছে বিপত্তি। একাধিক ব্লকের আধিকারিক ও পঞ্চায়েত প্রধানদের দাবি, নতুন নির্দেশিকায় মজুরি দেওয়ার পুরো কাজটাই করতে হবে অনলাইনে। ফলে কাজ শেষের পরে মাস্টার রোল তৈরি করার পরে তা অনলাইনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই মতো মজুরি সরাসরি শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে চলে যাওয়ার কথা। তাঁদের অভিযোগ, কিন্তু ডাকঘরের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পরিকাঠামোগত সমস্যার জন্য শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে মজুরি ঢুকছে না।” বিশেষ করে অনলাইনে ফর্ম পূরণ করার ক্ষেত্রে ডাকঘরগুলির নির্দিষ্ট সঞ্চয় কোড দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।

প্রশাসন সূত্রে খবর, এই জেলার ৭০ শতাংশের বেশি পঞ্চায়েতে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে মজুরি দেওয়া হয় ডাকঘরের মাধ্যমে। প্রত্যন্ত এলাকায় ডাকঘরের শাখাগুলিতে ইন্টারনেট পরিষেবা না থাকায় মজুরি দেওয়ার প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে। বহু পঞ্চায়েতেও উন্নত মানের ইন্টারনেট পরিষেবা না থাকায় সে ক্ষেত্রেও সমস্যা বেড়েছে। ওই সব পঞ্চায়েতের কর্মীদের কথায়, “নতুন পদ্ধতিতে মজুরি দেওয়ার পুরো কাজটাই অনলাইনে করতে হয়। এ জন্য ব্রডব্যান্ডের মতো দ্রুতগতির ইন্টারনেট পরিষেবা পঞ্চায়েত থাকা জরুরি। কিন্তু অনেক পঞ্চায়েতেই তা নেই।” জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে মজুরি দেওয়ার কাজ অনেকটা সারা গেলেও ডাকঘরের মাধ্যমে বকেয়া মজুরির পরিমাণ প্রায় ১৮ কোটি টাকা। কিছুদিন আগে সাড়ে আট কোটি টাকা ডাকঘরের বিভিন্ন শাখায় পৌঁছনোর কাজ শেষ হলেও এখনও প্রায় ১০ কোটি টাকা বাকি রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে বহু পঞ্চায়েত প্রধান ও আধিকারিকদের একাংশের দাবি, কিছু জেলায় অনলাইনে জটিলতা তৈরি হওয়ায় শ্রমিকদের মজুরির অর্থ সরাসরি ডাকঘরগুলিতে দেওয়া হচ্ছে। ডাকঘর থেকে সেই অর্থ শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে জমা করা হচ্ছে। এতে জটিলতা এড়িয়ে দুর্নীতিও ঠেকানো যাচ্ছে। কিন্তু নির্দেশিকা অক্ষরে অক্ষরে মানার পক্ষপাতী জেলা প্রশাসন।

একশো দিনের প্রকল্পের অতিরিক্ত জেলা কো-অর্ডিনেটর তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক প্রকাশ পাল বলেন, “অনলাইনে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ায় ডাকঘরের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ডাকঘর কর্তৃপক্ষ দ্রুততার সাথেই কাজ করছে। দ্রুত শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী আমরা।” জেলা ডাকঘরের এক কর্মকর্তা বলেন, “এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা সম্ভব নয়। যা বলার ঊর্ধ্বতন কতৃর্র্পক্ষ বলবে।”

মজুরি চেয়ে পঞ্চায়েতে তালা
নিজস্ব সংবাদদাতা • বান্দোয়ান

কাজ করেও মজুরি না মেলায় ক্ষোভে পঞ্চায়েতে তালা দিলেন শ্রমিকরা। বুধবার বান্দোয়ানের চিরুডি পঞ্চায়েতের ঘটনা। এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ শতাধিক শ্রমিক পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। চিরুডি গ্রামের বাসিন্দা শ্যামলাল হাঁসদা, প্রতিমা টুডু বলেন, “আমরা রাস্তা ও পুকুর সংস্কারের কাজ করেছি কয়েক মাস আগে। কিন্তু এখনও মজুরি মেলেনি।” পঞ্চায়েতে থেকে আশ্বাস ছাড়া আর কিছু পাননি। তাই তালা ঝোলাতে বাধ্য হয়েছেন বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন। চিরুডি পঞ্চায়েতের প্রধান হরিপদ সিং বলেন, “শ্রমিকদের অভিযোগ সত্যি। আমরা ওদের মজুরির টাকা আগেই ছেড়ে দিয়েছি। তবু কেন পান নি তা জানতে ডাকঘরে যোগাযোগ করছি।” বান্দোয়ানের বিডিও মধুসূদন মণ্ডল বলেন, “শ্রমিকদের মজুরি মেলেনি বলে শুনেছি। তাঁরা যাতে শীঘ্র টাকা পান তা নিয়ে প্রধানের সাথে কথা বলব।”

kali puja wages outstanding labour subhraprakash mondal raghunathpur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy