পুরুলিয়া হাসপাতালে ভর্তি রাশি টুডু।—নিজস্ব চিত্র।
জানগুরুর নিদান মেনে ডাইনি অপবাদ দিয়ে এক বিধবা প্রৌঢ়াকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে গ্রামের মাতব্বরদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, সালিশি সভায় ডেকে এনে ওই প্রৌঢ়াকে ডাইনি সাব্যস্ত করার পরে প্রথমে আর্থিক জরিমানা করা হয়। পরে অনেক লোকের সামনেই লাঠি দিয়ে ওই মহিলাকে পিটিয়ে তাঁর হাত বেঁধে গ্রামে ঘোরানো হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে বাঘমুণ্ডি থানা এলাকার রাঙা গ্রামে। আদিবাসী অধ্যুষিত এই গ্রামটি অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। বর্তমানে রাশি টুডু নামে ওই প্রৌঢ়া বাঘমুণ্ডির পাথরডি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিত্সাধীন। অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ গ্রামের দুই মাতব্বরের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেছে। তবে, সেটি নিছকই মারধরের মামলা। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমার বলেন, “ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তে যা উঠে আসবে, তার ভিত্তিতে পুলিশ পদক্ষেপ নেবে। ঘটনায় জড়িতদের ধরা হবে।”
পুরুলিয়ার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় ডাইনি বা ডাইন অপবাদ দিয়ে গ্রামের মানুষের উপরে অত্যাচার নতুন নয়। জরিমানা, মারধর থেকে শুরু করে সামাজিক ভাবে একঘরে রাখাএমন নজির এই জেলায় একাধিক আছে। রাশিদেবীও সেই অন্ধবিশ্বাসের শিকার। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রাঙা ও বাড়েলহর গ্রাম দু’টির অবস্থান প্রায় পাশাপাশি। বাড়েলহর গ্রামে সম্প্রতি দু’জনের মৃত্যু হয়। কেন লোক মারা যাচ্ছে, তা জানতে এলাকার মাতব্বরেরা এবং আরও কিছু লোকজন গত বৃহস্পতিবার ঝাড়খণ্ডের বোকারোর কাছে জনামোড় নামে একটি জায়গায় জানগুরুর কাছে যান। জানগুরুর নিদান নিয়ে ফিরে আসার পরে শুক্রবার সালিশি সভা বসে গ্রামে। ওই সভায় জানগুরুর নিদান মোতাবেক ঠিক হয়, বাড়েলহর গ্রামের রাশি টুডুই ডাইনি। সভায় ওই প্রৌঢ়াকে ১০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। তার পর তাঁর জন্যই গ্রামের অমঙ্গল হচ্ছে, এই অপবাদ দিয়ে মহিলাকে মারধর করে খড়ের দড়িতে হাত বেঁধে ঘোরানো হয় রাঙা ও বাড়েলহর দুই গ্রামেই।
মারের যন্ত্রণা সহ্য করে শুক্রবার রাতটা কোনও রকমে রাশিদেবী বাড়িতেই কাটান। শনিবার তাঁর ছেলে শিবচন্দ্র টুডু মাকে পাহাড়ের নীচে পাথরডি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে এসে ভর্তি করান। ওই ঘটনার জেরে এখনও আতঙ্ক কাটেনি শিবচন্দ্রের। তাঁর কথায়, “আমি শুক্রবার ওই সময় বাড়িতে ছিলাম না। যখন সভা বসে, তখন চাষজমিতে ছিলাম। দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি আমার ছোট মেয়েটা কাঁদছে। বাড়ি থমথমে। তার পর সব শুনলাম।” তিনি জানান, রাশিদেবীকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়েছে। যে দশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল, তার মধ্যে টাকা তাঁরা দিতে পেরেছেন। বাকিটা এখনও জোগাড় করে উঠতে পারেননি। কে সালিশি সভায় নেতৃত্ব দিয়েছিল, জানতে চাওয়ায় ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় শিবচন্দ্রের মুখ। পাথরডি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “অনেকেই তো ছিল। আমি নাম জানি না।”
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের শয্যায় যন্ত্রণার চোটে পাশ ফিরতেও পারছেন না রাশিদেবী। কথা বলতে গেলেই কুঁকড়ে যাচ্ছে চোখমুখ। কোন রকমে বললেন, “আমি বারবার বলছিলাম, আমাকে মেরো না, আমি ডাইনি নই। কেউ শুনল না। আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে খড়ের দড়ি দিয়ে বেঁধেছিল। আর সঙ্গে লাঠির বাড়ি। এক জন চিত্কার করে কিছু বলতেই খুলে দিল।”
রাঙা গ্রামের বাসিন্দারা শুক্রবারের ঘটনা সম্পর্কে মুখ খুলতে চাননি। পুলিশ জানিয়েছে, মারধরের ঘটনায় মূল দুই অভিযুক্ত পলাত। তাঁদের খোঁজ চলছে। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, সেদিন রাশিদেবীর সঙ্গে আরও এক মহিলাকে একই ভাবে ডাইনি অপবাদ দিয়ে মারধর করা হয়েছিল। আর্থিক জরিমানাও করা হয়। তবে তাঁকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি হতে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সম্পাদক তথা পুরুলিয়া সদর হাসপাতালের চিকিত্সক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “অত্যন্ত বর্বরোচিত ঘটনা। ওই মহিলার গায়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল বলে শুনেছি। সোমবার পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করে, এ ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ করতে বলব।” জানগুরু বা ওঝাদের বাড়াবাড়ি ঠেকাতে কী করা যায়, তা নিয়েও পুলিশ সুপারের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন নয়নবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy