Advertisement
E-Paper

তিন ছেলে খুন, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বৃদ্ধা মা

চার বছরে বহু কিছু পাল্টেছে। ঠাঁই পাল্টেছে। ইতিউতি ছিটকে গিয়েছে পরিবার। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ছয় ভাই। শুধু বিচার মেলেনি। ২০১০ সালের ৪ জুন রাতে লাভপুরের নবগ্রামে খুন হয়েছিলেন সিপিএম সমর্থক তিন ভাই। যাঁর বাড়িতে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বলে অভিযোগ, তিনি এখন তৃণমূলের ‘দাপুটে’ বিধায়ক।

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৬
ভেঙে পড়েছে নিহত কোটন শেখের বাড়ি। লাভপুরের নবগ্রামে।  ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

ভেঙে পড়েছে নিহত কোটন শেখের বাড়ি। লাভপুরের নবগ্রামে। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

চার বছরে বহু কিছু পাল্টেছে।

ঠাঁই পাল্টেছে। ইতিউতি ছিটকে গিয়েছে পরিবার। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ছয় ভাই। শুধু বিচার মেলেনি।

২০১০ সালের ৪ জুন রাতে লাভপুরের নবগ্রামে খুন হয়েছিলেন সিপিএম সমর্থক তিন ভাই। যাঁর বাড়িতে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল বলে অভিযোগ, তিনি এখন তৃণমূলের ‘দাপুটে’ বিধায়ক। শুধু মাঝরাতে ছেলেদের রক্তাক্ত মুখ মনে পড়ে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে মায়ের।

ঘটনার নেপথ্যে ময়ূরাক্ষীর ঘাট থেকে বালি তোলা নিয়ে দুই গোষ্ঠীর রেষারেষি। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, কাজিয়ার সালিশি করতে দুই গোষ্ঠীকে বাড়িতে ডেকেছিলেন সদ্য ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া মনিরুল ইসলাম। দু’পক্ষই তাঁকে বখরা দিত বলে কানাঘুষো বহু দিনের। এক তরফে হাজির ছিলেন নয় ভাই। মনিরুলের উস্কানিতে অপর দল তাঁদের উপরে চড়াও হয় বলে অভিযোগ। পাঁচ জন পাঁচিল টপকে পালাতে পারলেও দু’জন সেখানেই খুন হয়ে যান। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় এক জনের। আর এক জনকে অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখে দুষ্কৃতীরা পালায়।

জাকের, কোটন এবং ওইসুদ্দিন শেখ নামে তিন ভাইয়ের খুনে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল ৫১ জনের বিরুদ্ধে। মাস দুয়েক পরে মনিরুল ধরা পড়েন। কিন্তু নিহতদের ভাই মজল শেখ, সাইফুদ্দিন শেখ, হাচু শেখ, জামাল শেখ, নিহত জাকেরের আলির ছেলে সলিমুদ্দিন শেখ ও আলিমুদ্দিন শেখ, নিহত কোটন শেখের ছেলে ফজলু শেখ ও অন্যতম অভিযোগকারী শানওয়ার শেখের ছেলে ফিরোজ গোপন জবানবন্দিতে জানান, মনিরুল ইসলাম ওই ঘটনায় জড়িত নন। মনিরুল জামিনে ছাড়া পেয়ে যান। বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল তাঁকে লাভপুর কেন্দ্রে দাঁড় করায়। তিনি জিতেও যান।

আর আক্রান্তেরা?

নবগ্রামে ঘরবাড়ি পোড়ো হয়ে পড়ে আছে। গোটা পরিবার গ্রামছাড়া। বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে ময়ূরেশ্বরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছেন কোটন শেখের স্ত্রী ফজিলা বিবি। জাকেরের স্ত্রী সেরেমানি বিবি রয়েছেন মুর্শিদাবাদে বাপের বাড়িতে। ফজিলার আক্ষেপ, “হাঁড়ি আলাদা হলে আমরা একান্নবর্তী পরিবারের মতোই ছিলাম। কিন্তু মনিরুল ইসলাম বিধায়ক হওয়ার পরে ভয়ে আমাদের যাযাবরের মতো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।” সেরেমানির অভিযোগ, “আমাদের নিয়মিত হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশ-প্রশাসনে জানিয়েও প্রতিকার পাইনি। উল্টে চাপের মুখে পড়তে হয়েছে।” নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে জেলায় সদ্য আসা পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খাঁ বলেন, “এ বিষয়ে কিছু জানা নেই। যদি ওঁরা লিখিত অভিযোগ করেন, খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।”

শুক্রবার বর্ধমানের একটি গ্রাম থেকে ফোনে নিহতদের এক ভাই দাবি করেন, প্রাণের ভয়েই তাঁরা ‘মনিরুল জড়িত নন’ বলে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। যদিও পুলিশের কাছে বা আদালতে তাঁরা এমন কিছু জানাননি। সিপিএমের লাভপুর জোনাল সম্পাদক পল্টু কোঁড়া দাবি করেন, “নিহতেরা এক সময়ে আমাদের সমর্থক ছিলেন। বর্তমানে কে কোথায় আছেন, জানি না। শুনেছি, বিধায়কের ভয়েই ওঁরা গ্রামছাড়া। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে দিয়ে ওঁদের মামলা তুলে নিতে বলা হচ্ছিল। সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে ওঁদের গ্রামছাড়া হতে হয়েছে।” নিহতদের আশি বছরের মা জরিনা বিবি ফোনে বলেন, “একের পর এক মামলার দিন পড়ছে আর হতাশ হয়ে পড়ছি। জানি না, জীবদ্দশায় খুনিদের সাজা দেখতে পাব কি না।”

ফরওয়ার্ড ব্লকে থাকার সময় থেকেই বারবার সিপিএমের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন মনিরুল। ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটের পরে অনুব্রত মণ্ডলের উপস্থিতিতে তিনি সদলবল তৃণমূলে যোগ দেন। তাতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তৃণমূলের বহু পুরনো নেতাকর্মী। লাভপুরে দলেরই বুথকর্মী খুনে অভিযুক্ত দুষ্কৃতী গোপাল শেখকে মদত দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তাঁর দাপট দিন-দিন বেড়েছে বই কমেনি। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে লাভপুর ব্লকে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতের কোনও আসনে তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দল প্রার্থীই দিতে পারেনি।

মনিরুল অবশ্য মন্তব্য করতে চাননি। ফোনে কোর্টের কথা তুলতেই মেজাজ হারিয়ে ধমকে ওঠেন, “আপনারা বাজে লোক। উল্টোপাল্টা লেখেন। আর ফোন করে বিরক্ত করবেন না।” ফোন কেটে যায়।

জরিনা বিবি শুধু বিড়বিড় করেন, “তিন ছেলের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মুখগুলো যখনই মনে পড়ে, ঘুম ভেঙে শিউরে উঠি। মানুষ হয়ে মানুষকে এ ভাবে মারতে পারে?”

lavpur arghya gosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy