Advertisement
০৫ মে ২০২৪
তিতিবিরক্ত বাঁকুড়া চাইছে, চালু হোক ‘সিটি সার্ভিস’

নেই অটো-টোটো, শহর থমকে রিকশায়

একটা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। রয়েছে পূর্ণাঙ্গ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। বড় তিনটি কলেজও এবং একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও আছে। স্কুল আছে গোটা কুড়ি। আর আছে বেশ কয়েকটি নার্সিংহোম।

বাঁকুড়ায় এই ছবি নিত্যদিনের। শহর হাঁসফাঁস। ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ।

বাঁকুড়ায় এই ছবি নিত্যদিনের। শহর হাঁসফাঁস। ছবি: অভিজিত্‌ সিংহ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৪ ০০:৪৯
Share: Save:

একটা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে। রয়েছে পূর্ণাঙ্গ সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। বড় তিনটি কলেজও এবং একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও আছে। স্কুল আছে গোটা কুড়ি। আর আছে বেশ কয়েকটি নার্সিংহোম।

সব মিলিয়ে আড়ে-বহরে শহর বাড়ছে। বাড়ছে লোকসংখ্যা। বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে। কিন্তু, বাঁকুড়া আছে বাঁকুড়াতেই!

সরু রাস্তা, প্রবল যানজট, রাস্তা জুড়ে হকারদের দাপাদাপি। এবং অবশ্যই রিকশাযা ছাড়া বাঁকুড়া শহরটাই যেন অসম্পূর্ণ। এ শহরে এলে আপনি সাইকেল পাবেন, দূরে যাওয়ার বাস পাবেন। ভাড়া গাড়িও পাবেন। কিন্তু, শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে ভরসা একটাইরিকশা! শহরের এক প্রবীণ নাগরিকের তাই কটাক্ষ, “বাঁকুড়া আসলে নামেই শহর। যে শহরে একটা অটো রিকশা চলে না, নিদেন পক্ষে ব্যাটারিচালিত রিকশার (টোটো বা টুকটুক) দেখাও আপনি পাবেন না, তা আবার শহর নাকি?”

ওই প্রবীণ যা বলেছেন, তা বাঁকুড়ার আম নাগরিকের একেবারে মনের কথাই।

শহরের বাসিন্দা তথা বাঁকুড়া জেলা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’-র জেলা সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন দরিপার আক্ষেপ, “বাঁকুড়ার কত কাছে দুর্গাপুর। অথচ বাঁকুড়ার সঙ্গে কত তফাত্‌! দুর্গাপুরে দূষণহীন সিএনজি অটো চলছে। বহরমপুরে চলছে ব্যাটারি চালিত রিকশা। অথচ, আমরা এখনও সেই সাইকেল রিকশাতেই আটকে রয়েছি।”

রিকশা-নামা

• শহরে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশার সংখ্যা প্রায় ৮০০।

• বিনা লাইসেন্সে চলছে আরও কয়েকশো।

• এ বছরের লাইসেন্স নবীকরণের কাজ শুরু হয়েছে।

• ১০০ দিনের প্রকল্পের জন্য ইদানীং শহরে গ্রামের রিকশা কম ঢুকছে।

• বাঁকুড়া পুরসভা আজও রিকশা ভাড়া বেঁধে দেয়নি। ফলে, রিকশা চালকেরা যে যেমন পারেন ভাড়া হাঁকেন।

• রিকশার দাপটে শহরের গতি রুদ্ধ। তবু হেলদোল নেই পুরসভা বা প্রশাসনের।

ঘটনাও তাই। ‘রিকশার শহর’ পরিচিতিতেই আটকে রয়েছে বাঁকুড়া। অথচ রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলা সদর ইতিমধ্যেই বিকল্প পরিবহণ ব্যবস্থার দিকে পা বাড়িয়েছে। কোথাও সিনএনজি অটো, কোথাও টোটো চালু হয়েছে। ফলে, তুলনামূলক কম ভাড়ায় অনেক পথ যাওয়া যায়। কিন্তু বাঁকুড়া শহরে রিকশার ভাড়ায় যেমন নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনই ব্যস্ত রাস্তায় ঝাঁকে ঝাঁকে রিকশা ঢুকে পড়ে যানজটও বাড়িয়ে শহরের গতি আরও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। হাতেগোনা কিছু অটো বা ট্রেকার চলে, কিন্তু, তা খুবই অনিয়মিত ও অপ্রতুল। অথচ, এক সময়ের পিছিয়ে পড়া জেলার তকমা ঝেড়ে যুগের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিচ্ছে বাঁকুড়া। দোকান-বাজার যেমন বাড়ছে, তেমনই তৈরি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শহুরে পরিষেবার তাগিদে গ্রামাঞ্চল ছেড়ে হু হু করে মানুষ এসে বাসা বেঁধেছেন পুরশহর বাঁকুড়ায়। মেডিক্যাল কলেজ-সহ একাধিক নার্সিংহোমের পরিষেবা পেতে প্রতি দিন শয়ে শয়ে মানুষ ছুটে আসছেন এই শহরে। ওষুধ ব্যবসা-সহ বিভিন্ন ব্যবসার সেলসম্যানদের ভিড় এখানে।

কিন্তু, শহরের ভিতরের পরিবহণ ব্যবস্থার হাল ফেরেনি। বাঁকুড়ার গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ড ও সর্বোপরি বাঁকুড়া রেল স্টেশন থেকে শহরের ভিতরের উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় রোজই দুর্ভোগে পড়তে হয় মানুষজনকে। বাঁকুড়া সারদামণি গার্লস কলেজের ছাত্রী, বড়জোড়ার বাসিন্দা স্নেহা দাস বলেন, “কলেজে আসার পথে বাসস্ট্যান্ড থেকে ট্রেকার পাওয়া যায়। কিন্তু ফেরার পথে কোনও রিকশা ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই।” নতুনচটি এলাকার ওই কলেজ থেকে অগত্যা ছুটির পরে রোজ তিনি টানা ২০ মিনিট হেঁটে কাছাকাছি বাসস্টপ পাঁচবাগায় গিয়ে বাস ধরেন। তাঁর কথায়, “বাইরে থেকে যত ছাত্রছাত্রী এই শহরে পড়তে আসে, সবাইকেই এই সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। শহরের অনেক কিছুই বদলাচ্ছে। অথচ যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে কেউ ভাবে না।”

দর করে লাভ নেই

• মাচানতলা-বাঁকুড়া রেলস্টেশন ২০-৩০ টাকা।

• মাচানতলা-সতীঘাট ৩০-৪০ টাকা।

• মাচানতলা-পাঁচবাগার মোড় ৩০-৪০ টাকা।

• মাচানতলা-লালবাজার ৩০-৩৫ টাকা।

• মাচানতলা-কেরানিবাঁধ ৩৫-৪০ টাকা।

একটি ওষুধ কোম্পানির বাঁকুড়ার এরিয়ার সেলস্‌ ম্যানেজার সন্দীপ রায় দুর্গাপুর থেকে পেশার টানে হামেশাই আসেন বাঁকুড়ায়। তাঁর কথায়, “বাস থেকে নামার পরে কার্যত হেঁটেই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেরাতে হয়। কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। নির্দিষ্ট রিকশা ভাড়া না থাকায় যে যা খুশি দর হাঁকে।” তাঁর আক্ষেপ, এখানে ভাল ‘মার্কেট’ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে তাঁদের মতো অনেকেই পরিশ্রম করছেন। কিন্তু, যাতায়াতের অব্যবস্থার কারণে প্রচণ্ড সমস্যা হচ্ছে। বেসরকারি একটি আর্থিক সংস্থার কর্মী, বড়জোড়ার বাসিন্দা শুভজিত্‌ ঘোষ বলেন, “শহরের কেরানিবাঁধ বাইপাস এলাকা থেকে সতীঘাট, জুনবেদিয়া, কাটজুড়িডাঙার মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে যেতে হলে আপনাকে মোটা অঙ্কের রিকশা ভাড়া গুনতেই হবে।” তাঁর দাবি, “এই সব রুটে অনায়াসে দুর্গাপুরের মতো সিএনজি অটো চালানো যেতেই পারে। কিন্তু কেউ এ সব নিয়ে ভাবে না।” রিকশা চালক শম্ভু বাগদি, ধনঞ্জয় গড়াইরা অবশ্য বলেন, “এক জন যাত্রী হলে ভাড়া কমই নিই। কিন্তু দু’জন হলে ভাড়া বেশি নিতেই হয়। রাস্তার হালও তো ভাল নয়। তবে, ভাড়া নিয়ে আমার নই, যাত্রীরাই অনেক সময় গোলমাল করে।”

শহরের পরিবহণ সমস্যা কাটাতে উন্নত ‘সিটি সার্ভিস’ দাবি করছেন সমাজের সবস্তরের মানুষ। মান্ধাতার আমলের পরিবহণ ব্যবস্থার বদল চাইছেন তাঁরা। প্রতাপবাগান এলাকার বাসিন্দা, সঙ্গীতশিল্পী জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “যানবাহনের ভাল বন্দোবস্ত না থাকায় পিছিয়ে পড়ছি আমরা। শহরের ভিতরে একান্ত ভাবেই অটো পরিষেবা চালু হওয়া উচিত। একই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট রিকশা ভাড়া করতেও পুরসভার উদ্যোগী হওয়া উচিত বলেই মনে করি।” বাঁকুড়ার একটি নার্সিংহোমের কর্ণধার তথা বিশিষ্ট স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ সুভাষ সরকারও শহরের পরিবহণ সমস্যা নিয়ে ক্ষুব্ধ। এই বিজেপি নেতা বলেন, “গর্ভাবস্থার প্রথম ও শেষ তিন মাস রিকশায় চাপলে ঝুঁকি থেকেই যায়। তুলনায় অটোয় ঝুঁকি অনেক কম। কিন্তু, এই শহরে অটো না থাকায় অনেক অন্তঃসত্ত্বাই রিকশায় চেপে আমার চেম্বারে আসতে বাধ্য হন। পুর-কর্তৃপক্ষের শহরের পরিবহণ উন্নয়নে কোনও নজরই নেই।’’

শহরজুড়ে এখন বাঁকুড়া পুরসভার ১৫০তম বর্ষ উদ্‌যাপন উত্‌সব চলছে। কিন্তু, এত বছর পরেও ‘রিকশার শহর’ তকমা থেকে বাঁকুড়ার মুক্তি না ঘোচায় ক্ষুদ্ধ পুরবাসী। মধুসূদন দরিপা বলেন, “শহরের গতি রুদ্ধ হয়ে রয়েছে। অটো চালানোর দাবি একাধিক বার পুরসভার কাছে তুলেও কাজ হয়নি।”

শহরের পরিবহণ ব্যবস্থার পরিবর্তন না হওয়ার দায় জেলা প্রশাসনের উপরেই চাপিয়ে দিচ্ছেন বাঁকুড়ার পুরপ্রধান শম্পা দরিপা। তাঁর দাবি, “গত তিন বছর ধরে একাধিক বার আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিকের (আরটিও) সঙ্গে শহরে অটো পরিষেবা চালু করার ব্যাপারে কথা বলেছি। পুরসভার তরফে শহরে অটো চালানোর ব্যাপারে ‘নো অবজেকশন’ দেওয়া হলও কাজ বেশি দূর এগোয়নি।” তিনি জানান, প্রাথমিক ভাবে ১০টি অটো শহরের মধ্যে বিভিন্ন রুটে চালানোর কথাও পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাঝে ওই দফতরের আধিকারিক পরিবর্তন হওয়ায় সেই উদ্যোগ থমকে গিয়েছে। তাঁর স্বীকারোক্তি, “শহরে পরিবহণ সমস্যা রয়েছে মানছি। তবে পুরসভার তরফে যতটা করার করেছি। তবে, আরটিও দফতরই এ বিষয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানেই আটকে রয়েছে কাজ।”

তবে, জেলাশাসক বিজয় ভারতী পুরসভার এই অভিযোগ শুনে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বহরমপুরে ব্যাটারি চালিত রিকশা চালু করার সময় সেখানে তখন অতিরিক্ত জেলাশাসকের পদে ছিলেন বিজয়বাবু। তিনি বলেন, “বহরমপুরের মতো এখানেও ব্যাটারি চালিত রিকশা চালানো যায় কি না, আমি দেখছি। শীঘ্রই পুরসভার সঙ্গে আলোচনায় বসব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE