Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ফের মাথা হেঁট হল, বলছে সব মহলই

ফের লজ্জায় মুখ ঢাকল বিশ্বভারতীর। শারীরিক নির্যাতনের পর মোবাইলে সহপাঠিনীর ছবি তুলে সাইবার দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি এবং ভয় দেখিয়ে মেয়েটির কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে কলাভবনে তাঁরই ‘সিনিয়র’ তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে। ভিন রাজ্যের ওই তরুণী মাত্র দু’মাস আগেই ভর্তি হন কলাভবনে। তিনি কলাভবনের অধ্যক্ষের কাছে গোটা ঘটনা জানিয়ে লিখিত অভিযোগও করেছিলেন।

দুপুর ১২.৪৭। কলা ভবনের নন্দনে বৈঠকের পর বাবার সঙ্গে বেরিয়ে আসছেন নির্যাতিতা ছাত্রী।

দুপুর ১২.৪৭। কলা ভবনের নন্দনে বৈঠকের পর বাবার সঙ্গে বেরিয়ে আসছেন নির্যাতিতা ছাত্রী।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০১:১৯
Share: Save:

ফের লজ্জায় মুখ ঢাকল বিশ্বভারতীর।

শারীরিক নির্যাতনের পর মোবাইলে সহপাঠিনীর ছবি তুলে সাইবার দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি এবং ভয় দেখিয়ে মেয়েটির কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে কলাভবনে তাঁরই ‘সিনিয়র’ তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে। ভিন রাজ্যের ওই তরুণী মাত্র দু’মাস আগেই ভর্তি হন কলাভবনে। তিনি কলাভবনের অধ্যক্ষের কাছে গোটা ঘটনা জানিয়ে লিখিত অভিযোগও করেছিলেন।

তবে, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অস্বস্তির এখানেই শেষ নয়। শুক্রবার তরুণীর সেই অভিযোগ ধামাচাপা দিতে চাওয়ার অভিযোগ উঠল বিশ্বভারতীর বিরুদ্ধেই! এবং সেই অভিযোগ তুললেন নির্যাতিতার বাবা। শুক্রবার সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেন, “কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওঁরা বলেছেন, মিডিয়া-পুলিশের কাছে গিয়ে কী হবে? আপনাদের যদি জামাকাপড়-পোশাক-তোয়ালে লাগে, তা হলে আমরা দেব।”

এ দিন শান্তিনিকেতনে বিষয়টি জানাজানি হতেই ক্ষোভ ছড়ায়। সব জেনেও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কেন চুপ, কেন অভিযুক্ত তিন জনকে চিহ্নিত করে এখনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না, পুলিশে কেনই বা অভিযোগ দায়ের করলেন কর্তৃপক্ষ--এমন নানা প্রশ্নে এ দিন দিনভর তোলপাড় হয়েছে বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাস। ছাত্রছাত্রীদের বড় অংশ তো বটেই, ‘ধিক্কার’ জানিয়েছেন প্রাক্তন থেকে বর্তমান আশ্রমিকেরা।

৮৭ সাল পর্যন্ত এই কলাভবনেরই ছাত্রী ছিলেন প্রখ্যাত ভাস্কর সোমনাথ হোড়ের মেয়ে শিল্পী চন্দনা হোড়। তিনি বলেন, “খুব লজ্জাজনক, এমনও শুনতে হচ্ছে নিজের ভবন নিয়ে! বাবার একটা স্টুডিও ছিল লালবাঁধে। এখন অবনপল্লিতে থাকি। শান্তিনিকেতনে একা থাকতেই ভয় করে। দিন দিন অত্যন্ত কর্কশ পরিবেশ হয়ে উঠছে এখানে, কলাভবনে। যেটা শিল্প ও শিল্পীদের পক্ষে খারাপ। এই ভবনের একটা ঐতিহ্য আছে। তদন্ত হওয়া দরকার। কর্তৃপক্ষের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।” এখনও কেন তা হল না, সে প্রশ্ন করলে তাঁর জবাব, “শান্তিনিকেতন বরাবরই চেপে রাখে। বাইরে দেখায় কিছু হয়নি, সব ভাল। আদতে সেটা নয়!”

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

নির্যাতিতা ছাত্রীর কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরও, তার ৪৮ ঘণ্টা পরেও বিশ্বভারতী কেন পুলিশকে ঘটনার কথা জানাল না, বা অভিযুক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না প্রশ্ন উঠছে সে নিয়েও। শান্তিনিকেতনে এসে ওই ছাত্রীর বাবা পুলিশে যাবে বলেই জানিয়েছিল। বৃহস্পতিবার উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত ও বিশ্বভারতীর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি মত বদল করেন।

অধ্যাপকসভার সম্পাদক কিশোর ভট্টাচার্য বলেন, “যে কোনও সুস্থ সমাজে এইরকম ঘটনা কাম্য নয়। বিশ্বভারতীর অধ্যাপকসভা গোটা ঘটনার তদন্ত চাইছে।”

কলাভবনের মতো একটি শিল্প-শিক্ষাকেন্দ্রে বারংবার কেন এমন অঘটন ঘটছে, প্রশ্ন সে নিয়েও। কলাভবনের এক প্রাক্তন ছাত্রীর মা এ দিন বলেন, “প্রাক্তন ছাত্রীর মা হিসাবে বলছি, এমন নির্যাতনের ঘটনা দিনের পর দিন ঘটছে। আমার মেয়ের সঙ্গেও ঘটেছে। বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে আসি। অভিযুক্তদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।” তিনি আরও বলেন, “সব থেকে খারাপ লাগে, ভবনের একাংশ এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শুনে।”

শিল্প ঐতিহাসিক এবং গবেষক ও কলাভবনের প্রাক্তনী অনিন্দ্যকান্তি বিশ্বাস বলেন, “বিশ্বভারতীর কলাভবন কর্তৃপক্ষের কাছে আমি অপমান ও হেনস্থার শিকার হয়েছি। ওই ভবনে এটা নতুন নয়। আমার পরিবারে তিন পুরুষের শিল্পচর্চা। শিল্পের সেই পাঠ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হই। যে প্রতিষ্ঠানের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগের আঙুল ওঠে, তাঁর কাছে আমরা কী আশা করব? এই ঘটনায় বিশ্বভারতীর আবারও মাথা হেঁট হল!” দিনভর ফেসবুকেও মন্তব্য পাল্টা মন্তব্যের ঝড় বয়ে যায়। এর আগে কর্তৃপক্ষের ও কলাভবনের নানা ঘটনার প্রসঙ্গও উঠে আসে সেই সব ‘পোস্ট’-এ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাক্তনীরা তাঁদের বক্তব্যে তুমুল সমালোচনা করেন বিশ্বভারতীর।

শুক্রবার ওই ছাত্রী ও তাঁর বাবা কলাভবনের নন্দন চত্বর থেকে বের হওয়ার মুখে ছাত্রছাত্রীদের একাংশকে চারদিকে জটলা করতে দেখা যায়। থমথমে পরিবেশ ছিল কার্যত গোটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই। নির্যাতিতা ছাত্রী প্রথম বর্ষের বলে তাঁর বন্ধুদের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ‘শেষ দেখে ছাড়ব’ বলতেও শোনা যায়। কোনও কোনও ছাত্র চিৎকার করে ক্ষোভও প্রকাশ করেন। বলতে থাকেন, “টাকা আর কাপড় দিয়ে মুখ বন্ধ করা যাবে না!”

এ দিন, ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভ দেখে সতর্ক কর্তৃপক্ষ কোনও কোনও ভবনে মিডিয়ার সামনে মুখ না খোলার অলিখিত নিষেধাজ্ঞাও জারি করে। কলাভবন চত্বরের নিরাপত্তা কর্মী থেকে শুরু করে আনন্দসদন হস্টেল পযর্ন্ত মিডিয়ার গতিবিধির উপর কড়া নজরদারিও চালায়।

কলাভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ যোগেন চৌধুরী বলেন, “যদি এটা ঘটে থাকে, সেটা খুবই লজ্জার। ওই ছাত্রদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হওয়া উচিত। কলেজ থেকে বের করে দেওয়া দরকার। কলাভবনে এসব ভাবাও যায় না। তবে এসবই সিনেমা-সংবাদমাধ্যমের প্রভাব।”

নির্যাতিতা ও তাঁর বাবা মুখ বন্ধের চেষ্টা করার যে অভিযোগ বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উঠেছে, সে প্রসঙ্গে যোগেনবাবুর বিস্মিত মন্তব্য, “জানি না সত্য কি না, কিন্তু এও কী সম্ভব!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

visva bharati torture student harassment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE