পরিবর্তনের হাওয়ায় রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান হয়েছে। কিন্তু রামপুরহাট মহকুমা এলাকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় টুকলি করার দাপট কমানো গেল না। বরং আরও যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এই ‘ছাত্র-বন্ধুরা’।
বারবার এই ঘটনা ঘটলেও কেন পুলিশ-প্রশাসন সতর্কতা নিচ্ছে না, উঠেছে সে প্রশ্নও। যদিও কী ভাবে এবং কবে এলাকায় টুকলি বন্ধ হবে তার সদুত্তর কোনও তরফে পাওয়া যায়নি।
বাংলা হোক বা ইংরেজি কিংবা অঙ্ক টুকলির জোগান দেওয়া দাদাদের থামানো যায় না। স্কুলের পাঁচিল টপকে, কার্নিস বেয়ে তরতরিয়ে উঠে উত্তর লেখা চিরকুটটা জানলার ফাঁক দিয়ে ঠিক নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীর হস্তগত করে তবে তাঁদের স্বস্তি। সম্প্রতি মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন এই এলাকার একটি স্কুলে এক তরুণীকেও টুকলি জোগান দিতে দেখা গিয়েছে। আবার সরু কঞ্চির ডগায় চিরকুট বেঁধে নীচ থেকে দোতলায় পরীক্ষার্থীর কাছে তা পৌঁছে দিতে দেখা গিয়েছে। রসিকজনের মন্তব্য, “এখন তো পরিবর্তনের সরকার চলছে। কিন্তু টুকলি-শাসকদের কী সরাতে পেরেছে?” বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, কয়েকটি স্কুলে তো বছর-বছর রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে টুকলি জোগান দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে নলহাটি থানার ভদ্রপুর মহারাজা নন্দকুমার হাইস্কুল, নলহাটি হরিপ্রসাদ হাইস্কুল, বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ, লোহাপুর মহাবীর রাম হাইস্কুল, চারুবালা বালিকা বিদ্যালয়, ভগলদিঘি হাইস্কুল, কুরুমগ্রাম মিত্রভূম হাইস্কুল, মেহেগ্রাম হাইস্কুল এই সমস্ত হাইস্কুলের পরীক্ষা কেন্দ্রে বারবার টুকলি জোগান দেওয়া চলে। এ নিয়ে ওই সব কেন্দ্রের শিক্ষকরা রীতিমতো বিরক্ত।
আবার টুকলি ঠেকাতে গিয়ে শিক্ষকদের উপর ছাত্র-অভিভাবকদের চড়াও হওয়ার ঘটনা যে ঘটেনি তাও নয়। কুরুমগ্রাম মিত্রভূম হাইস্কুলে গত বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় টুকলি নিয়ে কড়াকড়ি করতে গিয়ে এক শিক্ষিকাকে পরীক্ষা শেষে এক ছাত্রী মাথায় স্কেল দিয়ে আঘাত করে জখম করেছিল। এ বছর নলহাটি থানার মেহেগ্রাম হাইস্কুলে টুকলি করতে বাধা দেওয়ার জন্য পরীক্ষা হলের ভিতরে এক শিক্ষিকাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রধানশিক্ষকের হস্তক্ষেপে তা মিটে যায়।
বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, নলহাটি থানা ছাড়াও মাড়গ্রাম থানার দুনিগ্রাম হাইস্কুল, রামপুরহাট শহরে রামপুরহাট হাইস্কুল, রামপুরহাট রেলওয়ে আদর্শ বিদ্যালয়, রামপুরহাট এস এম বিদ্যায়তন, রামপুরহাট নিশ্চিন্তিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এই সমস্ত স্কুলগুলি বর্তমানে টুকলি জোগানের শিরোনামে চলে এসেছে। তাঁদের প্রশ্ন, বার বার একই স্কুলে-স্কুলে এই ধরনের কাণ্ড চললেও পুলিশ-প্রশাসন থেকে শিক্ষা দফতরের আধিকারিক বা জনপ্রতিনিধিরা কেন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারছেন না?
শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিকের মতে, পরীক্ষার মূল কেন্দ্রগুলিকে আরও ছোটও ছোটও করে ভেঙে দেওয়া উচিত। তাতে করে আরও ভালভাবে নজর দেওয়া যাবে। আবার কিছু স্কুলের প্রধানশিক্ষকরা বলছেন, “পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের থেকে বাইরে অভিভাবকদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। সেন্টারের আশেপাশে পুলিশি নজরদারি চালানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তাই আরও পুলিশ মোতায়েন করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রশাসনকেও আরও কড়া পদক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু শুধু বাইরেই নজরদারি চালালে যে হবে না। অনেক পরীক্ষার্থী টুকলি নিয়ে ভিতরে যেমন ঠুকছে, তেমনই নিষেধ সত্ত্বেও মোবাইল ফোন নিয়ে ভিতরে ঢুকছে। তাদের কী ভাবে ঠেকানো যাবে? কিছু পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা বলেন, “আমরা পরীক্ষার্থীদের পকেট এবং ব্যাগ পরীক্ষা করব কী ভাবে? তা ছাড়া আমরা কড়াকড়ি করলে পরীক্ষার্থীরা হামলা চালাতেও পারে।’’ এক শিক্ষক জানান, একবার এক পরীক্ষার্থী টুকলি করতে বাধা দিলে পরীক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে আত্মহত্যা করারও হুমকি দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকরা অসহায়।
রামপুরহাটের মহকুমাশাসক উমাশঙ্কর এস বলেন, “পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ থাকে। মোবাইল ফোন নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রের ভিতরে ঢোকা আটকাতে আগামী দিনে আরও সতর্ককা নেওয়া হবে।” তিনি জানান, পরীক্ষা কেন্দ্রে টুকলির জোগান এবং নকল বন্ধ করা ও পরীক্ষা যাতে সুষ্ঠু ভাবে ভাবে হয় তার জন্য সেন্টার ইনচার্জ, সেন্টার সুপার ভাইজার, ভেনু ইনচার্জ, প্রধানশিক্ষকদের সঙ্গে কাউন্সিলের নমিনিদের নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যে টুকলি ঠেকানো যায়নি তিনি তা মেনে নিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy