Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বই কিনতে চেয়ে খোঁটা, টাওয়ারে চড়ল কিশোর

মোবাইলের টাওয়ারের উপরে মুখ গোঁজ করে বসেছিল ছেলেটা। আকাশের মুখও গোমড়া। মেঘলা আকাশের দিকে তাকাতে গিয়ে পড়শিদের নজরে ব্যাপারটা ধরা পড়তে শোরগোল পড়ে যায় পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে সাধুডাঙা এলাকায়। সদ্য একাদশ শ্রেণিতে ওঠা মা মরা ছেলেটার কী হয়েছে?

চার ঘণ্টা টাওয়ারে বসে থাকল এই কিশোর। —নিজস্ব চিত্র।

চার ঘণ্টা টাওয়ারে বসে থাকল এই কিশোর। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০০:৫৪
Share: Save:

মোবাইলের টাওয়ারের উপরে মুখ গোঁজ করে বসেছিল ছেলেটা। আকাশের মুখও গোমড়া। মেঘলা আকাশের দিকে তাকাতে গিয়ে পড়শিদের নজরে ব্যাপারটা ধরা পড়তে শোরগোল পড়ে যায় পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে সাধুডাঙা এলাকায়। সদ্য একাদশ শ্রেণিতে ওঠা মা মরা ছেলেটার কী হয়েছে? দাদুর জমিতে খাড়া হওয়া মোবাইলের টাওয়ারেই বা সে কেন উঠে বসেছে? এমনই নানা প্রশ্ন পড়শিরা গলা চড়িয়ে জানতে চাইছিলেন। কিন্তু প্রায় একশো ফুট উঁচু টাওয়ারের চূড়োয় গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা সমীর খাঁয়ের কানে সে সব পৌঁছলে তো! অনেকে ছুটলেন পুলিশে খবর দিতে। কয়েকজন দৌড়ে গেলেন পাশের জাতীয় সড়কের উঁচু সেতুতে। যদি সেখান থেকে চিৎকার করে কথা বললে ছেলেটার টাওয়ারে চড়ার কারণ জানা যায়।

লোকজন যখন হইচই করছেন, তখন শুকনো মুখে একপাশে দাঁড়িয়েছিল সমীরের ভাই সৌরভ। তার কাছেই জানা গেল, কথায় কথায় সৎ মা ও বাবার কথার খোঁচায় অভিমান করে বৃহস্পতিবার রাতে তার দাদা দাঁতে কুটোটি কাটেনি। এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টায় সেই অভিমানেই টাওয়ারে সে চড়ে বসে। সব শুনে পড়শিরা তো থ। আরে এ সব কথা আগে কেন জানায়নি? আকাশে মুখ তুলে তাঁরা চিৎকার করতে থাকেন, “ওরে ও সমীর নেমে আয় বাবা। আগে কেন এ সব কথা জানাসনি? তোর বাবা-মা, দাদুকে বলে সব ঠিক করে দেব। আমরা তো আছি।” পাড়ার কাকিমা, জেঠিমারা বলা বলি করতে থাকেন, আহা রে! মা মরা ছেলে কতটা আঘাত পেলে তবে এ ভাবে অত উঁচুতে উঠে পড়ে। ততক্ষণে খবর পেয়ে ছুটে আসেন পুলিশ ও দমকলের কর্মীরাও। কিন্তু টাওয়ারে চড়তে গেলে যদি হিতে বিপরীত হয়! ছেলেটা যদি ঝাঁপ দেয়? এই ভয়ে তাঁরাও কিছুই করতে পারছিলেন না। পড়শিদের সঙ্গে কয়েকজন পুলিশও শেষে সমীরকে নেমে আসার জন্য গলা মেলান।

টানা ঘণ্টা চারেক ধরে চলতে থাকে নীচে নামার জন্য সাধাসাধি। শেষে বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ বরফ গলে। টাওয়ারের খাঁজে খাঁজে পা রেখে নেমে আসে সমীর। ছুটে গিয়ে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরলেন, কেউ বা গায়ে মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিলেন। কিন্তু সমীরের মুখে হাসি নেই। চোখ ছলছল।

কিসের অভিমান? ছোট ভাই সৌরভ জানায়, তাঁরা দুই ভাই পুঞ্চার লৌলাড়ার একটি স্কুলে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। মা মারা গিয়েছেন বছর দশেক আগে। তারপর থেকেই তাঁরা সৎমায়ের সংসারে মানুষ। সৌরভের কথায়, “মা কথায় কথায় দাদাকে খোঁটা দেয়। ক’দিনের ছুটিতে বাড়ি এসে দাদা বাবাকে একটা বই কিনে দিতে বলেছিল। উল্টে বাবা ওকে নানা কথা শোনায়। দুঃখে দাদা বৃহস্পতিবার খাওয়াদাওয়াও করেনি। সেই দুঃখেই দাদা দাদুর জমিতে বসানো মোবাইল ফোনের টাওয়ারে উঠে পড়েছিল।”

টাওয়ারে উঠলে কেন? মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে সমীর। বিড়বিড় করে বলে, “দাদুই আমাদের সব খরচ দেয়। বাবার কাছে শুধু একটা বই চেয়েছিলাম। তা নিয়ে যা শুনতে হল, তারপর আর ভাল লাগছিল না। তাই টাওয়ারে উঠে পড়েছিলাম।” পড়শি কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, “টাওয়ার থেকে সমীর বলছিল তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। ঝাঁপ দিয়ে দেবে। সবাই মিলে চিৎকার করে বোঝাতে তবে নেমে এসেছে। না হলে কী কাণ্ড যে হয়ে যেত কে জানে!”

বাড়ির পাশেই যখন এই কাণ্ড, তখন অবশ্য এলাকায় সমীরের মা ও বাবাকে দেখা যায়নি। বাড়ি ছিলেন না দাদু ফকির খাঁ-ও। তিনি গিয়েছিলেন বাঁকুড়ায়। পড়শিদের ফোনে শুনেছেন নাতির কাণ্ড কারখানা। ফোনেই বলেন, “আমার ছেলে ও বৌমা নাতিগুলোর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। সমীর কিছু যে করে বসেনি, এটাই আমার সৌভাগ্য।” পুরুলিয়ার দমকলের ওসি সুদীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “ছেলেটি প্রায় ৯০ ফুট উঁচুতে উঠেছিল। কিন্তু ওই টাওয়ারে নিরাপত্তারক্ষী থাকার কথা। কী ভাবে ছেলেটি উপরে উঠল তা নিরাপত্তারক্ষীর দেখার কথা ছিল।” সমীরের সৎমা রীনা খাঁ জানিয়েছেন, আর্থিক টানাটানির জন্যই সমীরকে বই কিনে দিতে পারিনি। আমার মেয়েকেও স্কুল ব্যাগ কিনে দিতে পারিনি। তবে আমরা ওকে মোটেই খোঁটা দিই না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

books mobile tower boy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE