Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বন্ধ লজ, তারাপীঠে আতান্তরে পুণ্যার্থীরা

সব হোটেল-লজ বন্ধ হয়ে গেলে পর্যটকেরা দুর্ভোগের শিকার হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারই আঁচ মিলল মঙ্গলবার সকালে তারাপীঠ এলাকায় পৌঁছে। আশপাশের কোন এলাকায় হোটেল-লজে রুম খালি আছে তা জানতে হুড়িহুড়ি পড়ে গিয়েছে পর্যটকদের মধ্যে। তবে এই হুড়োহুড়ি মঙ্গলবার সকাল থেকে হয়, সোমবার রাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে।

আবর্জনায় ভরে গিয়েছে দ্বারকা নদ।

আবর্জনায় ভরে গিয়েছে দ্বারকা নদ।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
তারাপীঠ শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৫
Share: Save:

সব হোটেল-লজ বন্ধ হয়ে গেলে পর্যটকেরা দুর্ভোগের শিকার হবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারই আঁচ মিলল মঙ্গলবার সকালে তারাপীঠ এলাকায় পৌঁছে। আশপাশের কোন এলাকায় হোটেল-লজে রুম খালি আছে তা জানতে হুড়িহুড়ি পড়ে গিয়েছে পর্যটকদের মধ্যে। তবে এই হুড়োহুড়ি মঙ্গলবার সকাল থেকে হয়, সোমবার রাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে।

কেন না, পর্যটক ও দর্শনার্থীরা যাতে দ্রুত হোটেল, লজ ছেড়ে দেন সে জন্য ওই দিন রাত থেকে তারাপীঠের বিভিন্ন লজে গিয়ে মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা লজের মালিকদের বলে এসেছেন। হঠাত্‌ সিদ্ধান্তে ওই সমস্ত হোটেল বা লজে থাকা পর্যটকেরা কোথায় গিয়ে উঠবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছাড়ায়। বিশেষ করে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে যাঁরা দলবেঁধে তারাপীঠে এসে দুঃস্থ মানুষজনকে খাওয়ান এবং শীত বস্ত্র দান করে নিজেদের একটি বার্ষিক উত্‌সব পালন করতে এখানে এসেছেন তাঁরা বেকায়দায় পড়েছেন। এ দিকে, আদালতের নির্দেশ মতো হোটেল-লজ বন্ধ রাখতে মালিকেরা এ দিন প্রায় ঘণ্টা খানেক মাইক নিয়ে তারাপীঠ ফাঁড়ি এলাকা থেকে কবিচন্দ্রপুর, মুণ্ডমালিনীতলা, তিনমাথা মোড় প্রচার করেন। যাতে দ্রুত দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের ছাড়পত্র পাওয়া যায়, প্রশাসনের উপর চাপ রাখতে আজ বুধবার সকাল থেকে তারাপীঠের সমস্ত ব্যবসা (ফুটপাত ব্যবসায়ীদেরও) এক দিনের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন মালিকেরা।

হঠাত্‌ মালিকদের এই সব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এ দিন দুপুরে তারাপীঠ তিন মাথা মোড়ে অবরোধ করেন পর্যটকদের একাংশ। অবরোধকারীদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত শিল্পী তথা গত বিধানসভা নির্বাচনে সাঁইথিয়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী পরীক্ষিত্‌ বালা। অবরোধকারীদের দাবি, তারাপীঠে তাঁরা লজ ভাড়া নিয়ে উত্‌সব পালন করতে এসেছেন। ওই উত্‌সবে যোগ দিতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ এসেছেন। কিন্তু এই অবস্থায় তাঁরা কোথায় যাবেন? এ রকমই একটি উত্‌সবে যোগ দিতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতার বেহালা, মোমিনপুর থেকে এসেছেন ৭০ জন। সোমবার দুপুর থেকে তাদের মধ্যে অনেকেই তারাপীঠের ফাঁড়ি সংলগ্ন একটি লজে উঠেছিলেন। তাঁরা জানান, সকালে বাড়ি ফেরার জন্য বুধবার দুপুরে রামপুরহাট হাওড়া এক্সপ্রেসে টিকিট রিজার্ভেশন করা আছে। অগত্যা তাঁদেরকে রামপুরহাটে থাকার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও এত লোকের থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে না।

দুপুর ১২টার মধ্যে হোটেল-লজ খালি করে দিতে হয়েছে।
তাই ব্যাগপত্র নিয়ে বাড়ি ফিরছেন পর্যটকেরা।

আবার দলবদ্ধ হয়ে তারাপীঠে এসে অবস্থার ফাঁপড়ে পড়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হচ্ছে কৃষ্ণনগরের ১০-১২ জন পর্যটককে। হাওড়ার বালি থেকে আসা ব্যবসায়ী বিকাশ দত্ত শোনালেন অন্য অভিজ্ঞতা। বললেন, “তারাপীঠে মাতারা দর্শন করতে সোমবার রাত তিনটের সময় রামপুরহাট স্টেশনে নেমেছি। সঙ্গে ন’জন বন্ধু-বান্ধব আছে। সকালে এসে শুনছি মঙ্গলবার দুপুর থেকে তারাপীঠের সমস্ত লজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ইচ্ছে ছিল তারাপীঠে মঙ্গলবার থাকব। আজ, বুধবার চলে যাব। তা তো হল না! এমনকী রাত জেগে এসে কোনও লজে উঠে একটু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে মা তারার কাছে পুজো দেব সেটাও করতে পারছি না। নদীতেও যে স্নান করব সেখানেও জল নেই।” এ বারই প্রথম তারাপীঠ দর্শন এসেছেন বারাসত নবপল্লির বাসিন্দা উত্তম দাস, মঙ্গল দাসরা। ট্যুরিস্ট বাসে করে তাঁরা তারাপীঠ ভোর চারটের সময় পৌঁছেছেন। ভোর থেকে তারাপীঠের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে লজ পাননি। আবার দমদমের বাসিন্দা দমকল কর্মী তপন বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ দশ বছর পরে তারাপীঠে পরিবার নিয়ে পুজো দিতে এসেছেন। তপনবাবুদের দেখা গেল ব্যাগ নিয়ে তারাপীঠ অটোস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে। বারাসতের নওয়াপাড়ার বাসিন্দা মানিক সাহা বললেন, “দীর্ঘ দশ বছর ধরে মাঘী পূর্ণিমার দিন পরিবারের সকলকে নিয়ে তারাপীঠ আসি। এ বারও এসেছি। কিন্তু এমন অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে ভাবতে পারিনি!”

প্রসঙ্গত, তারাপীঠ শ্মশান লাগোয়া দ্বারকা নদীর জল দূষণ রুখতে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করেছিলেন আইনজীবী জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। সমস্যা খতিয়ে দেখে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে আদালতে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। গত ডিসেম্বর মাসে পর্ষদ রিপোর্ট দাখিল করে জানায়, তারাপীঠের হোটেল, লজ বা রেস্তোরাঁ থেকে বর্জ্য সরাসরি দ্বারকায় ফেলা হয়। ওই সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই নিকাশি বা বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই। তারাপীঠ মন্দিরের ফুল বা পুজোর কাজে ব্যবহৃত অন্য সব জিনিসও সরাসরি নদীর জলে মেশে। এ ছাড়া তারাপীঠ শ্মশানের আধ পোড়া শব, পোড়া কাঠ বা দাহ কার্যে ব্যবহৃত জিনিসপত্রও সরাসরি ওই নদীতে ফেলা হয় বলে জানানো হয়। তার জেরেই মজতে বসেছে দ্বারকা। গত ৮ জানুয়ারি মামলার শুনানিতে পর্ষদের আইনজীবী আদালতে আরও জানান, বর্তমানে তারাপীঠে মাত্র ৫-৭ শতাংশের হোটেল, লজ বা রেস্তোরাঁর পর্ষদের ছাড়পত্র রয়েছে। বেশির ভাগেরই ছাড়পত্র পুনর্নবীকরণ হয়নি। অনেকেই ছাড়পত্র নেওয়ার ব্যাপারে কোনও দিন আবেদনই করেনি! শুক্রবার মামলার শুনানিতে পর্ষদের ছাড়পত্র না থাকা তারাপীঠের সমস্ত হোটেল, লজ বা রেস্তোরাঁ অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশ দেয় আদালত। একই সঙ্গে তারাপীঠের যে সব হোটেল, লজ বা রেস্তোরাঁ ওই ছাড়পত্র পুনর্নবীকরণ করেনি বা পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে, যথাযথ পরিদর্শন করে তবেই তাদের ছাড়পত্র দেওয়া যাবে বলে জানিয়ে দিয়েছে আদালত। তারই জেরে রবিবার থেকে হোটেল-লজ বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছিল তারাপীঠে।

লজ মালিকদের পক্ষে বীরভূম জেলা পরিষদের প্রাক্তন সহ-সভাধিপতি ফব-র নিতাই মাল, তৃণমূলের রামপুরহাট ২ ব্লক সভাপতি সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “আদালতের নির্দেশকে সম্মান জানিয়ে আমরা তারাপীঠে ব্যবসা করতে চাই। সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার বিষয়টি দ্রুত কার্যকর করতে আবেদন যানাচ্ছি।” নদী দূষণের ক্ষেত্রে সেচ দফতরকে দায়ী করে নিতাইবাবু বলেন, “আগে বছরে তিন থেকে চার বার দ্বারকা নদে জল ছাড়া হত। নদীর বহমান জলে যাবতীয় ময়লা ধূয়ে মুছে যেত। সেটা বন্ধ থাকার জন্য নদী দূষণ আরও বেড়েছে।” বীরভূম জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলেন, “আদালতের নির্দেশ সকলকে মেনে চলতে হবে। তবে পর্যটকদের কথা ভেবে দ্রুত সমস্যা মেটানোর জন্য সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।”

ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tarapith lodge close problem
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE