Advertisement
E-Paper

বহুতলে মুখ ঢাকছে রামপুরহাট

বিদ্যাসাগরপল্লি, জীবনানন্দপল্লি, গুরুপল্লি, সুকান্তপল্লি...। বছর দশেক আগেও রামপুরহাট শহরে এমন সব নামের পল্লির কোনও অস্তিত্ব ছিল না। আর এখন শহরের পুরনো জলাভূমি চাকলামাঠ, ধূ ধূ প্রান্তর মাঠপাড়া, ভাগাড়পাড়ার মতো এলাকাগুলি বহুতলের ভিড়ে সেগুলির চেহারা বদলছে, নামও বদলেছে। যেমন চাকলামাঠই কোথাও হয়েছে বিদ্যাসাগরপল্লি, কোথাও আবার রাজীবপল্লি।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০০:১৯
এই বহুতলের সামনে দমকল ঢোকার পথ নেই।

এই বহুতলের সামনে দমকল ঢোকার পথ নেই।

বিদ্যাসাগরপল্লি, জীবনানন্দপল্লি, গুরুপল্লি, সুকান্তপল্লি...।

বছর দশেক আগেও রামপুরহাট শহরে এমন সব নামের পল্লির কোনও অস্তিত্ব ছিল না। আর এখন শহরের পুরনো জলাভূমি চাকলামাঠ, ধূ ধূ প্রান্তর মাঠপাড়া, ভাগাড়পাড়ার মতো এলাকাগুলি বহুতলের ভিড়ে সেগুলির চেহারা বদলছে, নামও বদলেছে। যেমন চাকলামাঠই কোথাও হয়েছে বিদ্যাসাগরপল্লি, কোথাও আবার রাজীবপল্লি। আবার আগের তুলনায় শহরের পরিধি, জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই হুহু করে বেড়েছে জমির দামও। এক দিকে জীবিকা ও উপার্জনের নানা নতুন দিক তৈরি হয়েছে। অন্য দিকে, পাল্লা দিয়ে জমি মাফিয়া আর প্রোমোটার রাজের বাড়বাড়ন্তও শহর প্রত্যক্ষ করেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শহরের পুরনো বাসিন্দাদের খেদ “ইঁট-বালি-সিমেন্টের ইমারতি ব্যবসা শহরটাকে গ্রাস করে ফেলছে!” তারই মাঝে শোনা যাচ্ছে, পুরসভা ও প্রশাসনিক নজরদারির অভাবে এবং একাংশের কর্মীর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় বেশির ভাগ নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন মানা হচ্ছে না। ফলে প্রদীপের আলোর নীচে অন্ধকারের মতোই প্রশ্নাতীত নয় জেলার গুরুত্বপূর্ণ শহরের এই ‘উন্নয়ন’।

ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী জেলায় রামপুরহাটের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। পাশেই তারাপীঠের মতো পর্যটনকেন্দ্র। লাগোয়া ঝাড়খণ্ড, দেওঘর ও মুর্শিদাবাদের সঙ্গে যোগাযোগও উন্নত। সঙ্গে পাথর শিল্পাঞ্চল। সব মিলিয়ে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোন থেকে এই শহরের কদর দিন দিন বেড়েই চলেছে। তার সঙ্গে বাড়ছে জমির দামও। শহরের ব্যবসায়ী সুজিতভূষণ গুপ্তের কথায়, “শহরের পাশ দিয়ে যাওয়া রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক এবং দুমকা-রামপুরহাট সড়কের দু’ধারের জমির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ১৫ বছর আগেও যে জমি কাঠা প্রতি মাত্র পঁচিশ হাজার টাকাতেই মিলে যেত, আজ তার জন্য ব্যবসায়ীরা ২০ লক্ষ খরচ করতেও পিছুপা হচ্ছেন না।” ওই দুই সড়ক থেকে বহু দূরে থাকা জমির দামেও কো একই পার্থক্য এসেছে। যেমন, ৩০ বছর আগেই চাকলামাঠে প্রতি কাঠা জমির দাম ছিল মাত্র ৫ হাজার টাকা। এখন তা ৪ লক্ষ টাকা! এলাকার ব্যবসায়ীদের দাবি, জেলায় এই শহরের জমির দামই সব থেকে বেশি!

দুই বহুতলের মধ্যে নূন্যতম ফাঁকও নেই। রাস্তায় পড়ে রয়েছে ইমারতি দ্রব্যও।

ওই দুই সড়কের দু’ধারে তো বটেই, এমনকী শহরের অভ্যন্তরেও এ ভাবে জমি কিনে আর পুরনো বাড়ি ভেঙে দেদার বহুতল নির্মাণ শুরুর চল দেখা যাচ্ছে। শহরের বোধ হয় কোনও প্রান্তই বাকি নেই যেখানে কোনও না কোনও বহুতল নির্মাণ হয়েছে কিংবা কাজ চলছে। ‘রামপুরহাট ডেভলপার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক আনিস আহমদ জানান, শহরে এই মুহূর্তে ৪২টি বহুতল নির্মাণের কাজ চলছে। তার মধ্যে ১৪টিতে বসবাস শুরু হয়েছে।

নিয়ম মেনে বহুতল তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ওই দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন বাসিন্দাদেরই একাংশ। গত কয়েক বছরে শহরে বহুতল নির্মাণ নিয়ে ভুরি ভুরি অভিযোগ জমা পড়ছে। প্রোমোটার আর জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যও বাড়ছে। নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই ঘিঞ্জি এলাকায় পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি করা হচ্ছে পেল্লায় বহুতল। পুকুর বুজিয়ে নির্মাণের অভিযোও উঠেছে। আবার কখনও জমির দালাল চক্রের পাল্লায় পড়ে হয়রান হচ্ছেন জমির প্রকৃত মালিক। শহরে কোথাও জি-প্লাস ফোরের বেশি কোনও বহুতল নির্মাণের অনুমতি নেই। সে নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই শহর ছেয়ে যাচ্ছে জি-প্লাস ফাইভে। আবার বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পে নির্মিত বাড়ি ভেঙে বহুতল নির্মাণের অভিযোগও উঠেছে। বাসিন্দাদের অধিকাংশেরই অভিযোগ, বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে জাল নথি তৈরি করা এবং প্রয়োজনীয় নিয়ম না মানায় পুরসভা ও ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক শ্রেণির কর্মীর বিশেষ সাহচর্যও দালালরা পাচ্ছেন।

দালাল চক্রের পাল্লায় পড়ে বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে নাজেহাল হতে হচ্ছে জমির প্রকৃত মালিকদেরও। সম্প্রতি শ্রীফলা এলাকায় বাড়ি করতে গিয়ে দালালদের হাতে বাধা পান শহরের এক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। তাঁর অভিজ্ঞতা, “কেনার পর কেউ যদি ওই জমি রেকর্ড না করে থাকেন, কিংবা ঘিরে না রাখেন, তা হলেই কিন্তু মুশকিল! জমি মাফিয়ারা বাড়ি তৈরিতে বাধা দিচ্ছে। জাল নথি দাখিল করে মালিকানা দাবি করছে।” এর পরেই কেউ যখন নিজের বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করছেন, তখনই জমি মাফিয়াদের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। ওই সময় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে অনেককেই মাফিয়াদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ।

নির্মিত বহুতলগুলির অনেকগুলি নিয়েও কম অভিযোগ নেই। এক, সমস্ত সরকারি বিধি মেনে নির্মাণ হচ্ছে না। দুই, দু’টি বহুতলের মাঝে যথা নির্দিষ্ট ফাঁক রাখা হচ্ছে না। তিন, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ঠিক নেই, কোথাও কোথাও দমকল ঢোকারও জায়গা নেই। সমস্ত অভিযোগই অবশ্য ‘রামপুরহাট ডেভলপার্স অ্যাসোসিয়েশন’ অস্বীকার করেছে। আনিস আহমদের দাবি, “সমস্ত নির্মাণই সরকারি বিধি মেনে হচ্ছে। ব্যবসায়িক বহুতলের ক্ষেত্রে একতলা নির্মাণের পরে সেই কাজ ঠিকঠাক হয়েছে কিনা, তা পুরসভা খতিয়ে দেখে। সব কিছু খতিয়ে দেখেই তার প্ল্যানের অনুমোদন দেয়।” তাঁর দাবি, ২০০৪ সালের পর থেকে পুকুরকে বাস্তুভিটে করার জন্য ভূমি দফতর আর অনুমোদন দেয় না। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ডেভলপমেন্ট ফি নিয়েও পুরসভা বহুতলের সামনে রাস্তা বা নিকাশি ব্যবস্থার কিছুই দেখে না।

কিন্তু সর্ষের মধ্যেই যে ভূত!

ব্যবসায়িক বহুতলই হোক কিংবা ব্যক্তিগত বহুতল কোনও ক্ষেত্রেই পুরসভার যথাযথ নজরদারি নেই বলেই অভিযোগ। আবার অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মীরা টাকা নিয়ে প্ল্যান পাস করিয়ে দেন বলেও অভিযোগ। অবৈধ বাড়ি ভেঙে ফেলার সাহসও পুরসভা দেখায় না। এ ক্ষেত্রে নজরদারির অভাবের কথা মেনে নিয়েছে তৃণমূল পুরবোর্ড। পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারি বলেন, “অস্বীকার করার উপায় নেই, নির্মাণের ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন থেকে পুরসভার নজরদারির অভাব আছে। অবৈধ নির্মাণের জন্য বহু ক্ষেত্রে শহরের উন্নয়নও বাধা পাচ্ছে।” তাঁর দাবি, পুরসভার হাতে মাত্র ৯ জন স্থায়ীকর্মী। তা সত্ত্বেও নির্মাণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বহু অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে নোটিসও জারি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেই তাঁর আশ্বাস।

ছবি: অনির্বাণ সেন

rampurhat apurba chattopadhyay multistoried building amar sohor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy