Advertisement
E-Paper

ভাষা স্মারক অর্ধসমাপ্তই, অবহেলায় ছড়াচ্ছে ক্ষোভ

মানভূমে বাংলা ভাষা রক্ষার লড়াইয়ের সঙ্গে বিশেষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে পুঞ্চার নাম। সময়টা ১৯৫৬ সাল। মানভূম জেলায় ভাষা আন্দোলন তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। পুঞ্চার ইতিহাসে যোগ হল নতুন অধ্যায়। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে সত্যাগ্রহীরা পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে (১০২৫ জন, মতান্তরে ১০০৫ জন সত্যাগ্রহী) কলকাতার উদ্দেশে পদযাত্রা শুরু করেন। তাঁদের মুখে-মুখে ঘুরছে মাতৃভাষা রক্ষার দাবি নিয়ে টুসু গান। মনে অদম্য জোর।

সমীর দত্ত

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৫ ০০:৫৩
ভাষা আন্দোলনের অসমাপ্ত স্মারক সৌধ। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

ভাষা আন্দোলনের অসমাপ্ত স্মারক সৌধ। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

মানভূমে বাংলা ভাষা রক্ষার লড়াইয়ের সঙ্গে বিশেষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছে পুঞ্চার নাম। সময়টা ১৯৫৬ সাল। মানভূম জেলায় ভাষা আন্দোলন তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। পুঞ্চার ইতিহাসে যোগ হল নতুন অধ্যায়। আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে সত্যাগ্রহীরা পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে (১০২৫ জন, মতান্তরে ১০০৫ জন সত্যাগ্রহী) কলকাতার উদ্দেশে পদযাত্রা শুরু করেন। তাঁদের মুখে-মুখে ঘুরছে মাতৃভাষা রক্ষার দাবি নিয়ে টুসু গান। মনে অদম্য জোর। যে ভাবেই হোক মানভূমের মানুষের দাবি কলকাতায় পৌঁছে নিয়ে যেতে হবে। দেশের ইতিহাসে মাতৃভাষা রক্ষার জন্য এত বড় মাপের পদযাত্রা বিরল।

পুঞ্চার ইতিহাস অতি প্রাচীন। গবেষকরা জানাচ্ছেন, বেশ কয়েকশো বছর আগে এখানে জৈন স্থাপত্য শিল্পকলা শিখরে উঠেছিল। পুরাকীর্তির নমুনা এখনও পুঞ্চা থানার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। তার মধ্যে বহু নিদর্শন নষ্টও হয়ে গিয়েছে। আবার জেলার বাইরেও বহু নিদর্শন পাচার হয়ে গিয়েছে। এর পরেও যা পুরা-নির্দশন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে, তার আকর্ষণও পর্যটকদের কাছে কম নয়। প্রবীণ বাসিন্দাদের একাংশের মতে, পুরুলিয়া তথা সাবেক মানভূম জেলা ও বাঁকুড়া জেলার সীমানায় পুঞ্চা থানায় ব্রিটিশ সৈন্যদের এক সময় শিবির ছিল। ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গলমহল অশান্ত হয়ে উঠেছে। শিবির থেকে সৈন্যরা গিয়ে অশান্তি দমন করত। কিন্তু জঙ্গলমহলের মানুষকে বাগে আনতে বার বার বেগ পেতে হয়েছে ইংরেজ শাসককে।

এই পটভূমিকায় পুঞ্চা থেকেই মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে পদযাত্রা শুরু হয়েছিল, যা এই জেলার অনেকের কাছে ভাষার স্বাধীনতার লড়াই ছিল। ২০ এপ্রিল পদযাত্রা শুরু হয়ে কলকাতায় পৌঁছয় ৬ মে। সে কথা আজ ইতিহাস। সত্যাগ্রহীদের আন্দোলনের চাপে শুধু এই এলাকায় বাংলা মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতিই পায়নি, তৎকালীন বিহার রাজ্য থেকে ভেঙে জন্ম নিয়েছিল নতুন জেলা— পুরুলিয়া। মাতৃভাষার অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ওই সালের ১ নভেম্বর নতুন জেলার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তাই এই জেলার ইতিহাসে পুঞ্চার নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ রয়েছে।

ইতিহাস বলছে, কংগ্রেসের রাজ্য ও জাতীয় নেতাদের সাথে মতবিরোধের জেরে ১৯৪৮ সালে মানভূম জেলার অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা দল ছেড়ে লোকসেবক সঙ্ঘ গঠন করেন। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাভাষী মানভূম জেলাকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিকে জাতীয় নেতারা গুরুত্ব দিচ্ছেন না, এই অভিযোগে বাংলায় অন্তর্ভুক্তির দাবিতে আলাদা একটি মঞ্চ করার দাবি উঠেছিল। তখনই তৈরি হয় লোকসেবক সঙ্ঘ। তবে কী কারণে পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রামকেই পদযাত্রা শুরুর জন্য বাছা হয়েছিল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। সঙ্ঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো জানান, সম্ভবত সঙ্ঘের বেশির ভাগ লোকজনের পক্ষে পুরুলিয়া শহর বা অন্য জায়গার থেকে পুঞ্চায় জমায়েত করা সুবিধা ছিল বলেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। হাজার পদযাত্রীর রওনা হওয়া থেকে শুরু করে তাঁদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, জলের জোগান, ১০টি দলের মধ্যে সমন্বয় সাধন, বিভিন্ন জেলায় খাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদির চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করে সত্যাগ্রহীরা পদযাত্রায় সামিল হন। লোকসেবক সঙ্ঘের পরিচালনায় এই কর্মকাণ্ড সাধিত হয়েছিল। সঙ্ঘের মুখপত্র ‘মুক্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, তখন মানভূমে লোকসেবক সঙ্ঘের দাপট ছিল। দলে ২ জন সাংসদ ও ১১ জন বিধায়ক ছিলেন। সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে সঙ্ঘের নেতৃত্ব রাজনৈতিক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করে শুধুমাত্র সামাজিক কাজে নিজেদের জড়ান। তার পর থেকে মানভূমের ভাষা আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রশাসনকে সে ভাবে কখনই এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি বলে অভিমান পুরুলিয়াবাসীর। সম্প্রতি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হল। কিন্তু এই জেলার সরকারি অনুষ্ঠানেই ডাক পেলেন না ভাষা সেনানিরা। ১ নভেম্বর জেলার জন্মদিনও জেলা প্রশাসন পালন করে না।

কলকাতা পদযাত্রার আগে পাকবিড়রায় শপথ নিচ্ছেন সত্যাগ্রহীরা।

ভাষা আন্দোলনে জড়িতদের অভিমানের আরও কারণ রয়েছে। ২০০৬-এ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পাকবিড়রায় এসে এই ইতিহাস সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে একটি স্মারক তৈরির কাজ শুরু হলেও তা অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে। বর্তমান সরকারের তরফেও ওই স্মারক সম্পূর্ণ করার উদ্যোগ নেই।

পুঞ্চার বাসিন্দা প্রশান্ত দত্ত, স্বরাজ গড়াইরা বলেন, “ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে পুঞ্চার যোগ থাকায় আমরা গর্ব অনুভব করি। কিন্তু এই ইতিহাস ধরে রাখা বা প্রচারের জন্য সরকারি স্তরে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।” এই গ্রাম থেকে অনেকেই পদযাত্রায় সামিল হয়েছিলেন। ওইসব পদযাত্রীদের বেশিরভাগই মারা গিয়েছেন। যাঁরা বর্তমান, তাঁরাও বয়সের ভারে আক্রান্ত। কেউ তাঁদের খোঁজ নেয় না। এতটা অবহেলা কি তাঁদের প্রাপ্য?— প্রশ্ন পুঞ্চাবাসীর।

amar shohor amar sohor language movement puncha samir datta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy