কোথাও মাকু চলছে ঠকাঠক শব্দে, ঘুরছে কুমোরের চাকা তো কোথাও তৈরি হচ্ছে কাঁসার বাসন। কোথাও বা লন্ঠনের মিত আলোয় চলছে শাঁখা কাটার কাজ। আবার কোথাও নিভৃতে রঙ লাগছে গোল দশাবতার তাসে।
মল্ল রাজধানী বিষ্ণুপুর জুড়ে ঘরে ঘরে এমন শিল্প-শালা। এই শিল্প সম্ভার আর নিয়েই মন্দির নগরী। এমন নয়, যে বিশেষ কোনও সময় বা মেলার জন্য এমন একটি শিল্পের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এ দৃশ্য প্রতিদিনের। কৃষ্ণগঞ্জ থেকে মাধবগঞ্জ, কালীতলার তাঁতি পাড়ায় শাঁখারিবাজার, কামারপাড়ায়-কুমোরপাড়া সবর্ত্র এই একই ছবি।
রাজ্যের অন্য কোনও শহরে একসঙ্গে এতগুলি হস্তশিল্পের নজির নেই। এই শিল্পগুলি শুধু রাজ্যে নয়, সারা দেশেই সুখ্যাতি অর্জন করেছে। তাঁতশিল্পে বিষ্ণুপুরের বালুচরী শাড়ি পেয়েছে সর্ব ভারতীয় পরিচিতি। বিষ্ণুপুরী চৌকো লন্ঠনও অন্য প্রদেশের মানুষ কিনে নিয়ে যান। বিশ্ববাজার জনপ্রিয়তা পেয়েছে এখানকার শাঁখা ও কাঁসাশিল্প। শিল্প রসিকদের কাছে বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাসও একটি বিশেষ লোক-শিল্প।
শহরের ইতিহাসে রয়েছে, বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা চৈতন্য শিষ্য শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর শিল্প ও মন্দির গড়ার কাজে নজর দেন। দিল্লি থেকে তানসেন পুত্র বাহাদুর খাঁকে আনিয়ে বিষ্ণুপুরে ভারতীয় মার্গ সংগীতের প্রচার ও প্রসার ঘটান। এসবের মধ্যেও মল্লভূমের নিরাপত্তা নিয়ে প্রখর দৃষ্টি ছিল তাঁদের। রাজধানী বিষ্ণুপুরকে শত্রুপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করতে অনেকগুলি গড় নির্মাণ করেছিলেন তাঁরা। সে সব গড়ের খাঁজে খাঁজে রাখা থাকত কামান। এরই বড় উদাহরণ বিষ্ণুপুর রাজবাড়ি ঢোকার মুখে গড়দরজা। প্রথমটি ছোট দ্বিতীয়টি বড়। রাজবাড়িকে সুরক্ষিত রাখতে তার চারপাশে তৈরি করা হয়েছিল পরিখা। শত্রুপক্ষ গোলাবারুদ নিয়ে যাতে ঢুকে পড়তে না পারে, সে কারণে জল ছেড়ে রাখা হত পরিখার চারপাশে। প্রবল গ্রীষ্মেও যাতে জলকষ্টে ভুগতে না হয় নগরবাসীকে, সেই কারণে বিষ্ণুপুরে খনন করা হয়েছিল সাতটি বাঁধ। দীর্ঘ সংস্কারের অভাবেও সেগুলি এখনো পুরোপুরি মজে যায়নি। শহরের সেই জলসংকট এখনও অনেকটাই দূর করে চলেছে লালবাঁধ, শ্যামবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ, যমুনাবাঁধের মতো বাঁধগুলি।
মারাঠা সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতের আক্রমণ প্রতিহত করতে পেরেছিলেন মল্ল রাজারা। তাঁরা যেমন যোদ্ধা, তেমনই ছিলেন সৃষ্টির সাধক। জোড় বাংলা, শ্যামরাই বা রাসমঞ্চের মতো স্থাপত্যকীর্তি সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিলেন তাঁরাই। যদুভট্ট, জ্ঞান গোস্বামী, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিষ্ণুপুর ঘরানার শতাধিক ওস্তাদ সংগীত শিল্পীর বিকাশ সেই সময়পর্ব থেকেই। এখানকার লোক-শিল্পের উদ্ভব বা বিকাশ-সবই হয়েছিল মল্ল রাজাদের সময় থেকেই।
রাজ-ইতিহাসের কয়েক শতাব্দী পর যখনই দেশের পর্যটন ক্ষেত্রে উজ্জ্বল হচ্ছে বিষ্ণুপুরের নাম, তখনই বিশেষভাবে মনে পড়ে সেই স্রষ্টাদের, যাঁরা একের পর এক অসাধারণ কারুকার্য মণ্ডিত মন্দির নির্মাণ করেছেন। বিষ্ণুপুরের মতো এত মন্দিরও নেই রাজ্যের কোনও শহরে। সেই কারণেই বিষ্ণুপুরকে বলা হয় শিল্প ও মন্দির নগরী।
শাঁখারিবাজারে মদনমোহন, মাধবগঞ্জে মদনগোপাল, বসুপাড়ায় শ্রীধর, রাসতলায় রাসমঞ্চ আর কালাচাঁদে ও রাজদরবার সংলগ্ন এলাকায় তো মন্দিরেরই মিছিল। গঠনশৈলিতে এইসব মন্দির যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনই মন্দিরগাত্রের টেরাকোটায় পুরাকীর্তির অনন্য নজির বহন করে চলেছে। স্থাপত্যের সেই অনন্য নিদর্শন নিয়েই পঞ্চরত্ন মন্দির শ্যামরাই, জোড়বাংলা ও রাসমঞ্চ ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’-এর অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে। ইদানীং বিদেশি পর্যটকদের কাছে এইসব অনবদ্য শিল্পকর্ম ও দর্শনীয় মন্দিরের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দক্ষিণবঙ্গের সেরা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে বাড়ছে এখানকার পর্যটন-শিল্প। পর্যটনকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগও হচ্ছে এখানে। তবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে এ শহরের চারপাশ।