Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পের আশা ফিকে, মুখ ঘুরিয়েছে লক্ষ্মী

ভারী শিল্প গড়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল জোরকদমেই। এলাকার আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি বদলানোর প্রত্যাশাটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল পুরো মহকুমা জুড়েই। কিন্তু শিল্পায়নের সম্ভাবনা ক্রমশ ফিকে হওয়ায় শিল্পহীন রঘুনাথপুরে তাই লক্ষ্মীপুজোর মূল সুরটাই কেটে গিয়েছে।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৪ ০১:১৪
Share: Save:

ভারী শিল্প গড়ার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল জোরকদমেই। এলাকার আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি বদলানোর প্রত্যাশাটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল পুরো মহকুমা জুড়েই। কিন্তু শিল্পায়নের সম্ভাবনা ক্রমশ ফিকে হওয়ায় শিল্পহীন রঘুনাথপুরে তাই লক্ষ্মীপুজোর মূল সুরটাই কেটে গিয়েছে।

পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই রঘুনাথপুর মহকুমার দু’টি ব্লক জুড়ে শুরু হয়েছিল একাধিক ইস্পাত, সিমেন্ট, বিদ্যুত্‌ কারখানা তৈরির কর্মকাণ্ড। শিলান্যাস হয়েছিল জয় বালাজী, শ্যাম স্টিলের মতো কারখানাগুলির। ভিতপুজো পর্যন্ত করেছিল আধুনিক গোষ্ঠী। প্রায় সমসাময়িক সময়ে সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠীর ছোট গাড়ি তৈরির কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিরোধিতায় রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হলেও, রঘুনাথপুরে কিন্তু স্বেচ্ছায় কারখানাগুলি গড়তে জমি দিতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু গত ছয়-সাত বছরে শুধুমাত্র ডিভিসি-র বিদ্যুত্‌ কারখানা ছাড়া কোন কারখানাই গড়ে ওঠেনি। একই চিত্র রেলের আদ্রা ডিভিশনের আদ্রা ও আনাড়ায়। সেখানে বিদ্যুত্‌ ও রেলের কামরার মধ্যবর্তী পুনর্বাসন কারখানা গড়ার কথা ঘোষণা করা হলেও কাজ শুরুই করা যায়নি।

কর্মসংস্থানের সুযোগের আশায় বুক বেঁধেছিলেন এলাকার তরুণরা। সংসারের রোজগার বৃদ্ধির সম্ভাবনায় দিন গুনছিলেন গৃহস্থ। কিন্তু কয়েক বছর ঘুরতেই এলাকায় শিল্প সম্ভাবনা বিশ বাঁও জলে যেতে দেখে সকলেই মুষড়ে পড়েছেন। একরাশ ক্ষোভ, অভিমান মনের মধ্যে রেখেই ঘরে-ঘরে পুজোর আয়োজন করতে চলেছেন রঘুনাথপুর মহকুমার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, শিল্পস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই এলাকায় লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ পড়বে বলে তাঁরা মনে করেছিলেন। কিন্তু শিল্প আসেনি, তাই লক্ষ্মীও অধরা।

রঘুনাথপুর ১ ব্লকের নতুনডি পঞ্চায়েত এলাকায় জয়বালাজী গোষ্ঠীর ইস্পাত, সিমেন্ট ও ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট গড়ার কথা। প্রয়োজনীয় জমির বেশিরভাগই অধিগ্রহণ করে এই শিল্পগোষ্ঠীকে দিয়েছে রাজ্য শিল্প উন্নয়ন নিগম। কিন্তু জমির লিজ চুক্তি রাজ্য সরকার এখনও না করায় কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু করেনি এই সংস্থা। এই প্রকল্পের জন্য জমি দিয়েছিলেন স্থানীয় দুরমুট গ্রামের বাসিন্দা পবন মাজি। ২০০৮ সালের শেষদিকে জমির আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পরে বাড়িতে বড় করেই লক্ষ্মীপুজো শুরু করেছিলেন তিনি। এখন তিনি বলছেন, “জমির পরিবর্তে যে টাকা পেয়েছিলাম, তা শেষ হয়ে গিয়েছে। অথচ কারখানা না গড়ে ওঠায় কর্মসংস্থানও হয়নি। আবার জমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় চাষও করতে পারছি না। এখন গত কয়েক বছর ধরে কোনও রকমে নমো নমো করে লক্ষ্মীপুজো করছি।”

হতাশ এলাকার যুবকরাও। রঘুনাথপুর শহরের সুভাষ বাউরি, দেবব্রত পালরা জানান, ডিভিসি-র প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার পরে সেখানে নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করার সুযোগ পেয়েছিলেন স্থানীয় যুবকরা। এতে এলাকায় আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল। সুভাষবাবুর কথায়, “ভেবেছিলাম দিন বদলাচ্ছে। তাই বাড়িতে ঘটা করে লক্ষ্মীপুজো শুরু করেছিলাম। আশা করেছিলাম রঘুনাথপুরে লক্ষ্মীদেবী স্থায়ী আসন পাততে চলেছেন। কিন্তু সুদিন বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল।” খুব দ্রুত রঘুনাথপুরে বড় মাপের বিনিয়োগ না এলে এলাকার আর্থিক অবস্থা লক্ষ্মীবিহীন হয়ে পড়বে বলেই মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

একই কথা বলছেন রঘুনাথপুর ২ ব্লকের মৌতোড়-মঙ্গলদা পঞ্চায়েতের ধানাড়া গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক তপনকান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়। এই এলাকাতেই আধুনিক গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়েছিল। তপনবাবুর কথায়, “শুনানিতে সবাই জানিয়েছিলেন, উপযুক্ত দাম ও ক্ষতিপূরণ পেলে জমি দিতে সমস্যা হবে না। আমরা.আশা করেছিলাম চাষের অনুপোযুক্ত রুক্ষ মাটিতে কারখানা গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থান হবে বেকার যুবকদের। কিন্তু তা আর হল কই!”

শিল্পায়নের হাত ধরে এলাকায় যে আর্থিক সমৃদ্ধি এসেছিল তার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পড়েছিল বাজারেও। “কিন্তু এখন বাজার যেন মনে গিয়েছে”, বলছিলেন রঘুনাথপুর শহরের ফল বিক্রেতা থেকে ফল ও ফুলের ব্যবসায়ীরা। ফল ব্যবসায়ী সম্পদ কর বলেন, “কারখানাগুলো গড়ে ওঠার কথাবার্তা শুরু হতেই বাজার তেজি হয়ে উঠেছিল। সেই সময়ে লক্ষ্মীপুজোয় যা ব্যবসা হত, এখন তার তুলনায় বিক্রিবাটা অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গিয়েছে।” একই অভিজ্ঞতা ফুল ও প্রতিমার সাজের ব্যবসায়ী প্রদীপ রেওয়ানির।

রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আদ্রায় এনটিপিসি-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তাপবিদ্যুত্‌ কারখানা গড়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। আনাড়ায় শুরু হয়েছিল রেলের কামরার মধ্যবর্তী পুনর্বাসন কারখানা গড়ার কাজ। বর্তমানে আনাড়ার প্রকল্প থমকে রয়েছে। আদ্রায় বিদ্যুত্‌ কারখানা গড়ার প্রাথমিক কাজটুকুও শুরু হয়নি। এলাকার বাসিন্দাদের কথায়, দু’টি কারখানা হলে আদ্রা ডিভিশনের হারিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধি ফেরত আসত। এলাকার ব্যবসা বাড়ত, কর্মসংস্থান হতে পারত। আক্ষরিক অর্থেই সবার লক্ষ্মীলাভ হত।

রেলকর্মী সংগঠনের নেতা সুব্রত দে, আদ্রার বাসিন্দা বাসুদেব বাউরির আক্ষেপ, “তাপবিদ্যুত্‌ কারখানার জন্য প্রস্তাবিত মোহনপুরা জঙ্গল এলাকার গাছ রাতারাতি সাফ হয়ে গেল। অথচ কারখানা হল না।” তাঁদের অভিযোগ, চোরা কারবারিদের হাতে পুরো জঙ্গলটাই শেষ হয়ে গেল! বস্তুত রঘুনাথপুর মহকুমা জুড়েই শিল্পায়নের হাত ধরে লক্ষ্মীদেবীর স্থায়ী আসন তৈরির সম্ভাবনাটা চোখের সামনে নষ্ট হতে দেখে পুজোতে মন ভাল নেই এলাকাবাসীর। আর এই কথাটা অস্বীকার করছেন না শাসক দলের বহু নেতা, কর্মীও। রঘুনাথপুরে তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা বিষ্ণুচরণ মেহেতার কথায়, “রঘুনাথপুরে বিশ্বকর্মার হাত ধরে এলাকায় লক্ষ্মীদেবীর স্থায়ী আসন তৈরি হতে পারত। কিন্ত এই আশাটা ক্রমশ মরীচিকা হয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তব সত্যটা অস্বীকার করি কি করে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE