Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পায়ন কি আদৌ হবে, প্রশ্ন ঘুরছে রঘুনাথপুরে

চিত্র ১: স্বামীর মৃত্যুর পরে শিল্পসংস্থা জয় বালাজিকে রঘুনাথপুরে অফিসের জন্য দেওয়া ভাড়াবাড়িই ছিল আয়ের অন্যতম উপায়। জয় বালাজি গোষ্ঠী রঘুনাথপুর শহর থেকে অফিস তুলে নেওয়ার পরে সেই আয় বন্ধ। প্রতি মাসের ভাড়া বাবদ সেই কয়েক হাজার টাকা হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন রঘুনাথপুর শহরের ব্লকডাঙ্গার বাসিন্দা, বিধবা বনানী দত্ত। চিত্র ২: ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কের পাশে নিজের লজের তিন তলার নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন পুটুক মাজি।

কারখানা হয়নি। বোর্ড আর ভাঙা পাঁচিলই যেন রঘুনাথপুরে শিল্পায়নের প্রতীক। ছবি: পৌলমী চক্রবর্তী

কারখানা হয়নি। বোর্ড আর ভাঙা পাঁচিলই যেন রঘুনাথপুরে শিল্পায়নের প্রতীক। ছবি: পৌলমী চক্রবর্তী

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৪ ০২:০০
Share: Save:

চিত্র ১: স্বামীর মৃত্যুর পরে শিল্পসংস্থা জয় বালাজিকে রঘুনাথপুরে অফিসের জন্য দেওয়া ভাড়াবাড়িই ছিল আয়ের অন্যতম উপায়। জয় বালাজি গোষ্ঠী রঘুনাথপুর শহর থেকে অফিস তুলে নেওয়ার পরে সেই আয় বন্ধ। প্রতি মাসের ভাড়া বাবদ সেই কয়েক হাজার টাকা হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন রঘুনাথপুর শহরের ব্লকডাঙ্গার বাসিন্দা, বিধবা বনানী দত্ত।

চিত্র ২: ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শহরের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কের পাশে নিজের লজের তিন তলার নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন পুটুক মাজি। ডিভিসি-র প্রকল্পে কর্মরত বিভিন্ন ঠিকা সংস্থা কাজ গুটিয়ে চলে গেছে। আসেনি নতুন শিল্প সংস্থাও। ফলে, যে লজে একটা সময় জায়গা পাওয়াই কঠিন হত, এখন সেই লজের একমাত্র আয় বলতে বিয়েবাড়িতে ভাড়া দেওয়া। তিন তলা নির্মাণ মাঝপথেই বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন পুটুকবাবু। চিন্তায়, ব্যাঙ্কের ঋণ মেটাবেন কী ভাবে।

চিত্র ৩: ডিভিসি-র প্রকল্প-সহ বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করে এবং প্রকল্পে মাটি কাটার কাজ করে আয়ের মুখ দেখেছিলেন রঘুনাথপুর শহরের বহু যুবক। দল গড়ে কাজ করছিলেন তাঁরা। তেমনিই একটি দল ব্যবসা বাড়ায় শহরের নাগ মার্কেট এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে অফিস পর্যন্ত খুলেছিল। দলটির অন্যতম কর্ণধার সুভাষ বাউরি-সহ অন্য যুবকেরা এখন প্রতিদিন অফিসে বসে আলোচনা করেন কবে সুদিন আসবে। কবে ফের নতুন কাজের বরাত মিলবে। সেই আশায় নিজেদের পকেট থেকেই অফিসের ভাড়া মেটাচ্ছেন তাঁরা।

চিত্র ৪: বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ডাম্পার কিনেছিলেন অনেক যুবক। বিভিন্ন শিল্প সংস্থায় নির্মাণ কাজে ও পণ্য পরিবহণে ডাম্পার ভাড়া দিয়ে উপার্জনও হচ্ছিল। দুই শতাধিক ডাম্পারের মালিককে নিয়ে গড়ে উঠেছিল ডাম্পার মালিকদের সংগঠন। সংগঠনের সভাপতি, শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নয়ন ঘোষাল জানাচ্ছেন, শিল্পের অভাবে গত দুই-তিন বছর যাবত কাজের অভাবে বসে রয়েছে অর্ধেকের বেশি ডাম্পার। বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ মেটাতে না পারায় বহু ডাম্পার মালিককে সংস্থাগুলি জানিয়ে দিয়েছে, গাড়ি ফেরত নিয়ে নেওয়া হবে।

পুরুলিয়ার শিল্পাঞ্চল হিসাবে খ্যাত রঘুনাথপুরের বাস্তব অবস্থাটা ঠিক কী, তা এই টুকরো ছবিগুলোই জানান দিচ্ছে। বস্তুত, এ রাজ্যে শিল্পায়নের অন্যতম মুখ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে রঘুনাথপুরকে। একটা সময় শিল্পায়নের ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রঘুনাথপুর উন্নয়নশীল শহর হিসাবে দ্রুত উঠে আসছিল পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-মানচিত্রে। গত তিন-চার বছর ধরে সেই উন্নয়নের রেখাচিত্র কিন্তু অধোগামী।

অথচ বাম আমলেই রাষ্ট্রায়ত্ত ডিভিসি-র পাশাপাশি জয় বালাজি, শ্যাম স্টিল, আধুনিক কর্পোরেশন, ডিসেরগড় পাওয়ার সাপ্লাই, এসআরএমবি, খাড়কিয়া স্টিল প্রভৃতি শিল্প সংস্থাগুলি রঘুনাথপুরে কারখানা গড়ার প্রস্তুতি শুরু করেছিল। আর বর্তমানে এখানে শিল্প বলতে জমিজটে জর্জরিত ডিভিসি-র নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরেই বা কিছু আগে রঘুনাথপুর থেকে হাত গুটিয়েছে অন্যান্য শিল্প সংস্থা।

যদিও ক্ষমতায় এসে একাধিকবার পুরুলিয়া সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, রঘুনাথপুরে শিল্প হচ্ছে। কিছুদিন আগেও পুরুলিয়ায় এসে তিনি জানিয়েছেন, রঘুনাথপুরে শিল্পনগরী হচ্ছে। বিনিয়োগ হবে ২৬ হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থান হবে ৪০ হাজার লোকের। কিন্তু, রঘুনাথপুর শহর ঘুরলেই বোঝা যায় মুখ্যমন্ত্রীর দাবির সঙ্গে বাস্তবের ফারাক কতটা।

ছবিটা কিন্তু এ রকম ছিল না। ২০০৮ সালের শেষ দিক থেকে ডিভিসি-র মেগা প্রকল্পের সুবাদে এবং অন্য শিল্পসংস্থাগুলির কারখানা গড়ার উদ্যোগে দ্রুতগতিতে আর্থিক মানোন্নয়ন ঘটেছিল পুরুলিয়ার অন্যতম পুরনো এই পুর-শহরের। নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ থেকে শুরু করে ডিভিসি-র প্রকল্পে মাটি কাটার সাব-কন্ট্রাক্ট পেয়ে লাভের মুখ দেখেছিলেন এলাকার বহু যুবক। ডিভিসি-র প্রকল্পে কর্মরত বিভিন্ন ঠিকাী সংস্থাগুলির কর্মী তো বটেই, ডিভিসি-র কর্মীরাও থাকতে শুরু করেছিলেন এই শহরে। দুই-তিন বছরের মধ্যে শহরে গড়ে উঠেছিল আটটি লজ, কয়েকটি হোটেল। পাশাপাশি বিভিন্ন ছোট সংস্থাকে অফিসের জন্য ভাড়া দিতে গড়ে উঠেছিল বড়-বড় বাড়ি। বহু লোক রাতারাতি নিজেদের বাড়ি দোতলা করে ভাড়া দিয়েছিলেন এক তলা। বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের খাবারের সংস্থান করতে বহুগুণ ব্যবসা বেড়েছিল খাবারের হোটেলগুলির। দামি ব্র্যান্ডের জামা কাপড় বিক্রি হচ্ছিল কাপড়ের দোকানে। বিভিন্ন সংস্থায় গাড়ি ভাড়া দিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছিল বহু যুবকের। বিক্রি বেড়েছিল চা ও পান-সিগারেটের দোকানগুলিরও। সব মিলিয়ে দ্রুত বদলে যাচ্ছিল শহরটা।

এখন সেই শহর জুড়ে হতাশার ছবি। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছে শহরটা। “এখন প্রাণ নেই শহরটায়, জানেন! একটা সময় কত কাজ ছিল। লোকজন ছিল। অফিস-কাছারি ছিল। আজ সে-সব কোথায়?”আক্ষেপ ঝরে পড়ে এক প্রবীণের গলায়।

ঘটনাও। জমির লিজ-চুক্তি নিয়ে জটে জয় বালাজির শিল্প গড়া হয়নি। রঘুনাথপুর শহরের ব্লকডাঙ্গায় সংস্থার অফিসের ঝাঁপও বন্ধ। জমি কিনেও পাততাড়ি গুটিয়েছে শ্যাম স্টিল। আর আধুনিক তারও আগে রঘুনাথপুর ছেড়েছে। শিবরাত্রির সলতে বলতে এখন শুধু রয়েছে ডিভিসি!

রঘুনাথপুরে এটাই শিল্পায়নের বাস্তব ছবি। সকালের দিকে নিজের ফাঁকা হোটেলে বসেছিলেন যুবক ব্যবসায়ী শুভজিৎ বসু। বলছিলেন, পাঁচ-ছয় বছর আগে ডিভিসি-র প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে শহরের ছবিটাই বদলে গিয়েছিল। তাঁর কথায়, “২০০৮-এর শেষ দিক থেকে ২০১২-এর প্রথম পর্যন্ত মাসে অন্তত ছ’হাজার লোক খেত আমার হোটেলে। আর এখন সেই সংখ্যা অর্ধেকেরও কম হয়ে গিয়েছে।”

শহরের এক হোটেলের মালিক সুরজিৎ বসু বলেন, “শিল্প গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরুর সময় থেকে শহরে বাইরে থেকে আসা লোকজনের সংখ্যা বেড়েছিলয় সেই দিকে তাকিয়েই আমরা ব্যবসায় লগ্নি বাড়িয়েছিলাম। চাহিদা দেখে হোটেলে এসি বসানো হয়েছিল। গত দুই তিন বছর ধরে ব্যবসায় মন্দা চলছে। এসি-র বিল মেটানোই দায়।”

একই ছবি লজগুলিতে। শহরের লজমালিক সংগঠনের কর্মকর্তা অসিত চৌধুরী বললেন, “আগে ব্যবসা ভাল ছিল। বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা লজগুলিতে থাকতেন। গত দুই-তিন বছরে লজের ব্যবসা ৭৫ শতাংশ কমে গিয়েছে।” জীবন বিমা নিগমের রঘুনাথপুরের অফিসের নীচে চায়ের দোকান রয়েছে সুপ্রিয় দাসের। তাঁর অভিজ্ঞতাও একই রমক। “দুই-তিন বছর আগে আমার দোকানে খদ্দেরদের ভিড় লেগেই থাকত। কত সংস্থার কর্মীরা চা-বিস্কুট খেতে এখানে আসতেন। আর এখন সেই ব্যবসার আধাও হয় না!”--বলছিলেন সুপ্রিয়বাবু।

আসলে শিল্পায়নের সাথে সমান্তরাল ভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ক্ষেত্র মার খেয়েছে কলকারখানা শেষ পর্যন্ত গড়ে না ওঠায়। শিল্পায়নের দিকে তাকিয়েই রঘুনাথপুর শহরের আশেপাশে শহরের যুবকরোই তৈরি করেছিলেন অন্তত ২৪টি ইটভাটা। আগে বছরে এই ভাটাগুলিতে ১২-১৫ লক্ষ ইট তৈরি হত। গত দুই-তিন বছরে উৎপাদন কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। পাল্লা দিয়ে কমেছে ইমারতি দ্রব্যের ব্যবসা। একই ছবি বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে। পাম্পমালিকদের সংগঠনের দাবি, গত কয়েক বছরে পাঁচ শতাংশের বেশি বিক্রি কমেছে শহর ও শহর লাগোয়া পাম্পগুলিতে।

এ ভাবেই শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার মুখ থুবড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিম্নগামী হয়েছে রঘুনাথপুরের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির হার। সুভাষ বাউরি থেকে শুভজিৎ বসু, সুপ্রিয় দাস থেকে অসিত চৌধুরী, পুটুক মাজি সকলেরই বক্তব্য “ডিভিসি-র প্রকল্প ঘিরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল রঘুনাথপুর। এই প্রকল্পে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষের দিকে। ফলে, কাজ গুটিয়ে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন ঠিকা সংস্থা। নতুন করে আর শিল্প আসছে কই? এই অবস্থায় রঘুনাথপুরে নতুন বিনিয়োগ না এলে অবস্থার বদল ঘটবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE